‘বাড়িঘর জ্বালিয়ে দিয়ে এখন চায় নাগরিকত্বের প্রমাণ’

  21-09-2017 05:47PM

পিএনএস ডেস্ক : মায়ানমারের রাখাইনে সেনাবাহিনীর নির্যাতনের শিকার হয়ে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্বের কোনো প্রমাণ বা কাগজপত্র না থাকলে তাদের আর ফিরিয়ে নেবে না-গত ৬ সেপ্টেম্বর বুধবার দেশটির জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা (এনএসএ) বৈঠকে এই বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়েছে। ঐদিন রাতে এক সাংবাদিক সম্মেলনে মায়ানমার সরকারের উপদেষ্টা ইউ থাং টুন বলেছেন, যাদের নাগরিকত্বের প্রমাণ নেই তাদের ফিরিয়ে নেয়া হবে না। তাদের এটা অবশ্যই প্রমাণ করতে হবে যে, তারা বহু বছর ধরে মায়ানমারে বাস করেন। যদি প্রমাণিত হয় তাহলে তারা ফিরে আসতে পারবেন। গত মঙ্গলবার প্রায় এই সুরে কথা বলেছেন, দেশটির স্টেট কাউন্সিলর অং সান সু চি। তবে এই সিদ্ধান্তকে মানতে রাজি নয় দেশটি থেকে পালিয়ে আসা নতুন রোহিঙ্গারা। তাদের মতে, সবকিছু জ্বালিয়ে পুড়িয়ে শেষ করে দিয়ে এখন তারা নাগরিকত্বের প্রামাণ চায়।

'ঘরে ঢুকে বাবাকে হত্যা করেছে। ঘরে আগুন দিয়েছে। আমাকে গুলি করে কোল থেকে ১ বছর ৮ মাস বয়সী দুধের শিশুকে সেই আগুনে পুড়িয়ে মারা হয়েছে।' কান্নাজড়িত কণ্ঠে ৩০ বছর বয়সী তাসলিমা বলেন, আবার তারা প্রমাণ চায় আমরা কোথাকার নাগরিক। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পায়ে গুলির আঘাত নিয়ে তাসলিমা বলেন, আমার সাজানো-গোছানো পরিবার তারা ধ্বংস করে দিয়েছে। তাসলিমার স্বামী মো. ইউনুস জানায়, ঐদিন তাদের পরিবারের ৮ সদস্যকে নির্মম ও নৃশংসভাবে হত্যা করেছে মায়ানমারের সেনাবাহিনী ও মগরা।

এদিকে মায়ানমারের মংডু এলাকার বাসিন্দা ইউসুফ নবী (২৫) সাংবাদিকদের বলেন, মায়ানমার সেনাবাহিনী মংডুতে আমাদের বাড়িঘর পুড়িয়ে দিয়েও ক্ষান্ত হয়নি। আমরা যাতে করে নিরাপদে এই দেশে (বাংলাদেশ) আসতে না পারি তাই সীমান্ত এলাকায় মাইন পুঁতে রেখেছে। আর সেই মাইনের আঘাতে আজ আমি পঙ্গু। মাইনের আঘাতে আমার ছিন্নভিন্ন পাটি কেটে ফেলতে হয়েছে। আর এখন তারা বলছে, নাগরিকত্বের প্রমাণের কথা। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ফ্লোরে শুয়ে কান্নাজড়িত কণ্ঠে ইউসুফ নবী বলেন, তারা (সেনাবাহিনী) আমাদের সবাইকে মেরে ফেলতে পারলে বাঁচে। আর মারার জন্য যা আছে তাই করছে স্থানীয় মগদের সাথে নিয়ে।

তবে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, এবার যেসব রোহিঙ্গা পালিয়ে এসেছে তাদের প্রত্যেকের তালিকা করা হয়েছে। তাদের কাছে প্রমাণ করার মতো ডকুমেন্টও রয়েছে।

এ প্রসঙ্গে কঙ্বাজারে রোহিঙ্গাদের মাঝে চিকিৎসা সেবাদানকারী ডাক্তার জয়নুল আবেদীন জানান, যেসব রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছে তাদের কাছে মায়ানমারের নাগরিকত্ব প্রমাণের মতো অনেক রকম ডকুমেন্ট রয়েছে। যার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে অনেক বছর আগে মায়ানমার সরকারের দেয়া ন্যাশনাল রেজিট্রেশন কার্ড। এছাড়াও জমিজমার দলিল, স্কুল কলেজে পড়ার সার্টিফিকেট, বিভিন্ন বিল বাবদ সরকারি খাতে টাকা জমা দেবার রসিদ ইত্যাদি প্রমাণ হিসেবে তাদের কাছে রয়েছে।

তবে অনেকেরই বাড়িঘরে আগুন ধরিয়ে দেয়ায় শুধু প্রাণটাকে হাতে করে নিয়ে ছুটেছেন নিরাপদ আশ্রয়ে। অনেকেই এসব প্রমাণাদি সাথে করে নিয়ে আসতে পারেননি বলে জানা গেছে।

কঙ্বাজারের জাতিসংঘের ত্রাণকর্মীরা জানিয়েছেন, রাখাইন রাজ্যে সহিংসতার শিকার হয়ে এখন পর্যন্ত প্রায় সাড়ে ৪ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছেন। এদের মধ্যে অনেকেই আহত-গুলিবিদ্ধ। তাছাড়া পালিয়ে আসার পথে স্থলমাইন বিস্ফোরণেও অনেকে আহত হয়েছেন এবং সমুদ্রপথে নৌকাডুবি হয়ে অনেক রোহিঙ্গা মারা গেছেন।

এদিকে বাংলাদেশ কোনো রকম সংঘাতে না জড়িয়ে মায়ানমারের সঙ্গে শান্তিপূর্ণ উপায়ে রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান করতে চায় জীবন বাঁচাতে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেয়াসহ রাখাইন রাজ্যের সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর দীর্ঘদিনের সমস্যার সমাধানে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সহযোগিতা চেয়েছে বাংলাদেশ।

মায়ানমার ছেড়ে মুসলিম রোহিঙ্গারা কেন চলে যাচ্ছে সেটি খুঁজে বের করার জন্য তাদের সঙ্গে কথা বলতে চান দেশটির স্টেট কাউন্সিলর অং সান সু চি। গত মঙ্গলবার তার দেয়া এমন বক্তব্য ডাহা মিথ্যাচার বলে দাবি করেছেন বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গারা। কঙ্বাজারের কুতুপালং রেজিস্টার্ড ক্যাম্পের তত্ত্বাবধানে থাকা 'পুরাতন রোহিঙ্গারা' সু চি'র বক্তব্যের তীব্র নিন্দা ও ক্ষোভ প্রকাশ করেন।

সু চি'র বক্তব্য শুনে ক্যাম্প তত্ত্বাবধায়ক ও পুরাতন রোহিঙ্গা মো. জাহান আলী বলেন, তার (অং সান সু চি) কথা শুনে মনে হলো তিনি অন্ধ। তিনি চোখে কিছুই দেখেন না। গত ৪-৫ দিন আগেও যারা মায়ানমার থেকে এখানে এসেছে, তাদের প্রায় সবার শরীরে গুলি আর জখমের চিহ্ন ছিল। এগুলো কীভাবে হয়েছে? সু চি মিথ্যা কেন বলছেন, যা সবাই খালি চোখে দেখছেন, কেন তিনি এসব অস্বীকার করছেন?

সম্প্রতি উখিয়া ও কুতুপালং ক্যাম্প পরিদর্শনের সময় কথা হয় 'পুরাতন রোহিঙ্গাদের'। ১৯৯১ সাল থেকে তারা মায়ানমার ছেড়ে বাংলাদেশে শরণার্থী হিসেবে বসবাস করছেন। বর্তমানে তারা ক্যাম্পের নতুন রোহিঙ্গাদের তত্ত্বাবধান করছেন। সুশৃঙ্খলভাবে ত্রাণ বিতরণে বিভিন্ন সংস্থায় কাজও করছেন তারা।

মায়ানমার সরকারের উপদেষ্টা ইউ থাং টুন বলেছেন, যাদের নাগরিকত্বের প্রমাণ নেই তাদের ফিরিয়ে নেয়া হবে না। তাদের এটা অবশ্যই প্রমাণ করতে হবে যে, তারা বহু বছর ধরে মায়ানমারে বাস করেন। যদি প্রমাণিত হয় তাহলে তারা ফিরে আসতে পারবেন।

মো. জাহান আলীর মতো আমাদের কাছে যথেষ্ট প্রমাণ আছে। কিন্তু কে দেবে আমাদের নিরাপত্তা। আমরা কার ওপর নির্ভর করে সেখানে যাবে। আর নানাভাবে টোপ দিয়ে আমাদের নিয়ে হত্যা করবে এই তো তাদের পরিকল্পনা।

কুতুপালং রেজিস্টার্ড ক্যাম্পের সমন্বয়ক মো. আইয়ুব বলেন, মায়ানমার সরকারের উপদেষ্টা ইউ থাং টুনের সাংবাদিক সম্মেলনের বক্তব্য ও সর্বশেষ গত মঙ্গলবার অং সান সু চি'র ভাষণ শুনে খুব অবাক হয়েছি। তার কথার সঙ্গে বাস্তবতার কোনো মিল নেই। যারা মারা গেছেন তারা তো গেছেনই, যারা বেঁচে ফিরেছেন তারাও আধমরা। এরপরও তার কোনো প্রতিক্রিয়া নেই। এরপরও তার হাস্যকর বক্তব্য!

ক্যাম্পের তত্ত্বাবধানে থাকা অন্য রোহিঙ্গারা বলেন, গত ২৭ বছর ধরে রোহিঙ্গা মুসলমান ও হিন্দুদের ওপর নির্যাতনের কারণে অনেকে মায়ানমার ছেড়েছেন। আরও অনেকে ছাড়বেন। তাদের পুনর্বাসনের চিন্তা না করে সু চি 'উন্মাদের' মতো বক্তব্য দিচ্ছেন।

'৫ সেপ্টেম্বর থেকে সেনাবাহিনীর অভিযান বন্ধ হয়েছে' বলে তিনি যে বক্তব্য দিয়েছেন সেটি ডাহা মিথ্যা। সর্বশেষ ১৭ সেপ্টেম্বরও মায়ানমার থেকে গুলিবিদ্ধ ও আহত রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে যার অস্তিত্ব দৃশ্যমান।

গত মঙ্গলবার জাতির উদ্দেশে দেয়া ভাষণে সু চি বলেন, অধিকাংশ মুসলমান রাখাইন থেকে পালাননি এবং সেখানে সহিংসতাও শেষ হয়ে গেছে। আমরা সব ধরনের মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং বেআইনি সহিংসতার নিন্দা জানাই। আমরা আমাদের দেশে শান্তি, স্থিতিশীলতা এবং আইনের শাসন পুনরুদ্ধারে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।

সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে আনা অভিযোগের বিষয়ে তেমন কিছুই বলেননি তিনি। সু চি বলেন, সেপ্টেম্বরের ৫ তারিখ থেকে কোনো ধরনের সশস্ত্র সংঘর্ষ বা জাতিগত নিধনের মতো কোনো ঘটনাই ঘটেনি। অধিকাংশ মুসলমান রাখাইনে থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তার মানে এটাই নির্দেশ করে যে পরিস্থিতি ততটা তীব্র নয়।

আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল বলছে, অং সান সু চি ও তার সরকার রাখাইন রাজ্যের ভয়াবহ পরিস্থিতির বিষয়ে বালিতে তাদের মাথা গুঁজে রেখেছেন।

আর জাতিসংঘ মায়ানমারের এই হত্যাযজ্ঞকে 'জাতিগত নির্মূল' হিসেবে অভিহিত করেছে।

তবে জাতির উদ্দেশে সু চি'র দেয়া বক্তব্য সম্পর্কে তেমন কিছু জানেন না নতুন রোহিঙ্গারা। আপাতত তারা মায়ানমারে ফেরার বিষয়েও কিছু ভাবছেন না।

প্রসঙ্গত, গত ২৪ আগস্ট মায়ানমার সরকারের কাছে দেয়া জাতিসংঘের আনান কমিটির রিপোর্ট বাস্তবায়ন না করার জন্যই পরিকল্পিতভাবে রাখাইন রাজ্যে এই নির্মম হত্যাযজ্ঞ চালানো হয়। মায়ানমারের সেনাবাহিনী বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে 'শুদ্ধি অভিযান'র নামে রাখাইন রাজ্যে নিরীহ মানুষের ওপর বর্বর নির্যাতন শুরু করে। অভিযানে হত্যা, ধর্ষণ, বাড়িঘরে আগুনসহ নানা নির্যাতনের ভয়ে এখন পর্যন্ত ৪ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় নিয়েছে।

পিএনএস/জে এ /মোহন

@PNSNews24.com

আপনার মন্তব্য প্রকাশ করুন