আ’লীগের তাণ্ডব: ‘খুনের বদলা নিতে নারী ধর্ষণ-লুটপাট’

  19-01-2017 03:21AM


পিএনএস: শরীয়তপুরের জাজিরায় আধিপত্য বিস্তার নিয়ে আওয়ামী লীগের দু’গ্রুপের সংঘর্ষে হোচেন খা নামে এককর্মী খুনের ঘটনার জের ধরে গত এক সপ্তাহ নিহতের সমর্থকরা প্রতিপক্ষের প্রায় দুই শতাধিক বাড়ি ঘরে হামলা ও লুটপাট চালিয়েছে। গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে প্রতিপক্ষের লোকজনের বাড়িঘর। এছাড়া ওই সকল বাড়িঘর পুরুষশূন্য হয়ে পড়ায় রাতের আঁধারে বেশ কয়েকজন নারীকে ধর্ষণ করার ঘটনা ঘটেছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
সরেজমিনে ঘুরে ও জাজিরা থানা সূত্রে জানা গেছে, আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে জাজিরা উপজেলার বড়কান্দি ইউনিয়নের আবদুল বেপারী কান্দি গ্রামে দীর্ঘদিন যাবত সাবেক ইউনিয়ন চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সদস্য সহি খলিফার ও বর্তমান চেয়ারম্যান ও একই কমিটির সদস্য সিরাজ সরদারের মধ্যে দীর্ঘদিন বিরোধ চলে আসছে। এরই জের ধরে গত ১০ জানুয়ারি সকালে উভয় গ্রপের সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। সংঘর্ষ চলাকালে উভয় গ্রুপের কমপক্ষে দুই শতাধিক ককটেলের বিস্ফোরণ ঘটে। এ সময় কমপক্ষে উভয় গ্রুপের কমপক্ষে ১৫ জন আহত হয়। আহতদের মধ্যে ককটেলের আঘাতে সফি খলিফার সমর্থক হোচেন খাঁ নামে এক আওয়ামী লীগ কর্মী খুন হয়।
ওই খুনের পর থানায় মামলা হয়। এরপর ওই এলাকায় পুলিশের ভয়ে বাড়িঘর ছেড়ে পুরুষ লোকেরা গা ঢাকা দিয়েছে। ফলে আবদুল বেপারী কান্দি গ্রাম এখন পুরুষশূন্য হয়ে পড়েছে। এ খুনের জের ধরে পুলিশের উপস্থিতিতে মঙ্গলবার থেকে শুরু করে গত বুধবার পর্যন্ত সপ্তাহব্যাপী অব্যাহতভাবে হামলা করে নিহতের আত্মীয় স্বজন ও দলবলের লোকেরা লাঠিসোঁটা, ঢাল-সরকি, ছেনদা, রামদা, ও ককটেল নিয়ে প্রতিপক্ষ সিরাজ সরদার সমর্থক হামেদ মাদবর, হজরত আলী মালত, ওমর আলী বেপারী, আনোয়ার হোসেন বেপারী, আ. শুকুর বেপারী, হোসেন বেপারী, তোতা মিয়া বেপারী, দিল মোহাম্মদ বেপারী, সামেদ আলী মাদবর, সিরাজ সরদার, আমির খাঁ, কাজল খাঁ, এমদাদুল হক খাঁ, শাহজাহান খাঁ, তোতা মিয়া, ওমর আলী বেপারীর বাড়িঘরসহ প্রায় দু’শতাধিক বাড়ি ঘরে হামলা করে ব্যাপক ভাঙচুর করে। এছাড়া ঘরে থাকা যাবতীয় মূল্যবান মালামাল লুটপাট করে নিয়ে যায়। হামলাকারীদের লাঠির আঘাতে মনোয়ারা বেগম, ফাহিমা বেগমসহ ওই দিন ৫ জন আহত হয়। এ সময় হামলাকারীরা সাত-আটজন নারীকে ঘর থেকে জোর করে ঘরের বাইরে নিয়ে শ্লীলতাহানি করে পুনরায় ঘরে ফেরত দিয়ে যায়। জীবনের ভয়ে নির্যাতিত নারীরা কেউ মুখ খুলতে সাহস পাচ্ছে না।
এছাড়া হামলাকারীরা এলাকায় নারীদের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের চাঁদা দাবি করে। চাঁদা দিতে অস্বীকার করলে তাদের ঘর বাড়ি ভেঙে গুঁড়িয়ে দেয়। বাধা দিতে গেলে মহিলাদের মারপিট করে। পুলিশ এ ঘটনা জেনেও না জানার ভান করছে।
এ ঘটনায় বাবুল বেপারী বাদী হয়ে ৬৫ জনকে আসামি করে জাজিরা থানায় একটি মামলা দায়ের করা হলে ও পুলিশ আসামিদের কাউকেই গ্রেফতার করতে পারেনি। এলাকাবাসীর অভিযোগ জাজিরা চরাঞ্চলে গত কয়েক বছর যাবত স্থানীয় আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে কমপক্ষে ১০টি খুনের ঘটনা ঘটলে ও কোনো খুনেরই বিচার হয়নি।




বড়কান্দি ইউনয়নের কুড়ি টাকার চর গ্রামের মোকলেছুর রহমান বলেন, আমাদের এলাকায় একের পর এক খুন হলে ও কোনো খুনেরই বিচার হয়নি। সরকার বদল হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে খুনিরা প্রভাবশালীদের সহায়তায় পার পেয়ে যায়। এতে করে দিন দিন খুনের সংখ্যা বেড়ে যাচ্ছে।
নির্যাতনের শিকার এক নারী বলেন, খুনের পর তার বাড়িঘরে পুরুষ লোক না থাকায় সুযোগ পেয়ে বুধবার রাত আনুমানিক দেড়টায় নিহতের সমর্থক লোকজন এসে ঘরের দরজা ভেঙে তার মেয়েকে ঘর থেকে বাইরে নিয়ে পাশবিক নির্যাতন করে ফেরত দিয়ে যায়। এ ঘটনা কারো কাছে প্রকাশ করলে মেরে ফেলার হুমকি দেওয়া হচ্ছে।
ওই নারী বলেন, ‘আমাদের ঘর থেকে বের হতে দেওয়া হয় না। লোকজন আমাদের পাহারা দিয়ে রাখছে। কারো কাছে যে বিচার চাইব সে উপায়ও নেই।’
আবদুল বেপারী কান্দি গ্রামের হজরত মালতের স্ত্রী মধুমালা বলেন, সফি খলিফার সমর্থকরা বুধার সকালে ৫০/৬০ জন লোক নিয়ে আমাদের বাড়ি ঘরে হামলা করে ব্যাপক ভাঙচুর ও লুটপাট করে ব্যাপক ক্ষতিসাধন করেছে। আমরা বাধা দিতে গেলে আমাকে লাঠি দিয়ে পিটিয়ে মারাত্মক আহত করেছে। পুলিশের কাছে জানানোর পরও আমরা কোনো বিচার পাইনি।
আমির খার স্ত্রী নাছিমা বেগম বলেন, খুনের পর আমরা বাড়ি ঘরে থাকতে পারি না। আমাদের পাইলেই নির্যাতন করবে। এ কারণে পালিয়ে থাকি। ১ লাখ টাকা চাঁদা চায়। আমি দিতে পারিনি। তাই গতরাতে আমাদের ঘর গুঁড়িয়ে দিয়েছে।
কাজল খার স্ত্রী রূপবান বলেন, সফি খলিফার লোকজন এসে চাঁদা চায়। আমাদের পুরুষ লোকের কোনো খবর নেই। আমরা টাকা দিব কইতনে। টাকা না দেয়াতে ঘরের মহিলাদের জোর করে নিয়ে নির্যাতন করে। যাওয়ার সময় হুমকি দেয় কারো কাছে বললে মেরে ফেলবে। পুলিশ কে জানালে তারা কিছু কয় না।
জাজিরা থানার ওসি মো. নজরুল ইসলাম বলেন, খুনের ঘটনার পর কয়েকটি বাড়ি ঘর ভাঙচুরের খবর পেয়েছি। এ ঘটনায় মামলা হয়েছে। তবে নারীদের নির্যাতনের কোনো অভিযোগ পাইনি।
হামলা ভাঙচুর, নারী নির্যাতনের বিষয়ে সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান সহি খলিফা বলেন, ‘আমার লোকেরা কেউ ভাঙচুর, লুটপাট, নারী ধর্ষণ করেনি। প্রতিপক্ষের লোকজন এই কাজ করে আমাদের বিপদে ফেলতে চাইছে। এগুলো তাদের কাজ।’
বর্তমান ইউপি চেয়ারম্যান সিরাজ সরদারের মোবাইল ফোনে কল দেওয়া হলেও তা বন্ধ পাওয়া যায়। ফলে তার বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি।
জেলা প্রশাসক মো. মাহমুদুল হোসাইন খান বলেন, ‘জাজিরার ওই গ্রামের বিষয়ে আমার কাছে কোনো তথ্য নেই। নারী ধর্ষণ, লুটপাট এরকম তো হওয়ার কথা না। কারণ এগুলোর ব্যাপারে আমরা খুব সিরিয়াস। উপযুক্ত তথ্য ও ভুক্তভোগীদের নাম ঠিকানা পেলে আমি ব্যবস্থা নেব।’

পিএনএস/হাফিজুল ইসলাম

@PNSNews24.com

আপনার মন্তব্য প্রকাশ করুন