আমরা কাশ্মীরি, আমাদের নিজস্ব সত্তা রয়েছে: ইনশা মালিক

  16-10-2016 04:41PM

পিএনএস ডেস্ক: কাশ্মীরের চমৎকার নৈসর্গিক সৌন্দর্যের জন্য তাকে পৃথিবীর ভূস্বর্গ বলে অবিহিত করা হয়। একই সঙ্গে দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে সামরিকায়ন জোন হিসাবে এটিকে একটি ভয়ঙ্কর স্থান হিসেবেও গণ্য করা হয়।

কাশ্মীরের জনসংখ্যার ৯০ শতাংশ মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ। ভারতীয় রাজত্ব থেকে মুক্তি পেতে কাশ্মীরের জনগণ গত ৬০ বছর ধরে ভারতের সঙ্গে যুদ্ধরত। কিন্তু তাদের দুর্দশা আন্তর্জাতিকভাবে খুব একটা মনোযোগ পায় না। কাশ্মীরের মত এখানকার নারীরাও রহস্যের আবরণে এবং ভারতীয় অপপ্রচারের মধ্যে লুকিয়ে আছে।

আমার মনে আছে, যখন আমি প্রথম কাশ্মীর থেকে ভারতের অর্থনৈতিক রাজধানী মুম্বাই ভ্রমণ করি। যেখানে স্বাধীনতাকে বুঝা কিংবা স্বাধীনতার দাবিকে প্রায় বিপ্লবের সদৃশ কিংবা চরমপন্থা বলে বিবেচনা করা হয়। অন্তত ভারতীয় মিডিয়ায় এমনটিই প্রচার করে থাকে। সেনা ক্যাম্পের অস্তিত্বহীনতা কিংবা কাঁটা তারের বেড়া ছাড়া এটিকে একটি অস্পষ্টতার হুমকি কিংবা অস্তিত্ববাদের সঙ্কট বলে মনে হয়।

প্রথমবারের মতো আমি মুম্বাইের একটি লোকাল ট্রেনে ওঠি। যেটি মুম্বাই শহরের পরিবহন ব্যবস্থার প্রাণকেন্দ্র। আমি লোহার একটি আসনে বসি এবং জানালা দিয়ে বাইরের দৃশ্য অবলোকন করতে থাকি। হঠাৎ ঐতিহ্যবাহী ভারতীয় পোশাক পরিহিত উগ্র কণ্ঠের একজন স্ত্রীলোকের কথায় আমার দৃষ্টি বাধাপ্রাপ্ত হয়। সে ছিল ভঙ্গুর, হালকা গড়নের। বেঁচে থাকার তাগিদে সে ট্রেনে পত্রিকা বিক্রি করছিল। ভারতে এরকম দারিদ্র্যতা ও হীন অবস্থায় আমি গভীরভাবে মর্মাহত হলাম।

কাশ্মীরে সবকিছুতেই আমরা চরম সংকটে আছি। আমাদের পরিচয় সংকট থেকে অবৈধ দখল ইত্যাদি নানা সঙ্কটের মধ্যে আমাদের দিন চলছে। কিন্তু কাশ্মীরের জাতীয়তাবাদী নেতাদের অনেক সংস্কার আমাদেরকে দারিদ্র্যের নিষ্ঠুরতা থেকে সাময়িক বিশ্রাম দিয়েছে।

আমি একটা দীর্ঘ শ্বাস নেই। কাশ্মীরকে একটি জীবন্ত নরকে পরিণত করার জন্য ভারত সরকারের প্রতি সবসময় আমার বিরক্তিভাব ছিল।

সেখানে একজন মধ্যবিত্ত ভারতীয় মহিলা নঅপ্রত্যাশিতভাবে আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসতে থাকে। এর কারণ সুস্পষ্টভাবেই আমার চেহারায় একটা বহিরাগত ভাব ফুটে ওঠেছে।

তিনি আমার সঙ্গে কথোপকথন শুরু করেন: ‘আপনি কি আরব থেকে এসেছেন?’ কেন সে আমাকে দেখে আরবের মানুষ বলে মনে হলো, ভেবে আমি অবাক হলাম। কিন্তু শিগগিরই আমি উত্তর খুঁজে পেলাম। আমার হিজাব এবং আমার মুসলিম পোশাকই ছিল এর কারণ।

আমি বললাম ‘না’ এবং উত্তর শুনে তিনি অনুমান করতে লাগলেন। ‘আপনি কি তাহলে ইরান থেকে এসেছেন?’ তখনো আমি বললাম ‘না’। ‘আমি ভারত থেকে এসেছি’ এটা বলা কি আমার উচিত হবে? আমি ভাবলাম। যেহেতু ভারত দাবি করে কাশ্মীর তাদের অবিচ্ছেদ্য অংশ।

কিছুক্ষণ চিন্তা করার পর আমি বললাম, ‘আমি কাশ্মীর থেকে এসেছি’। কাশ্মীর শব্দটি শুনে ভদ্রমহিলার মুখে বিস্ময়ের সৃষ্টি হল। আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে কাশ্মীর স্পষ্টতই আফগানিস্তানের সদৃশ। সে বলল, ‘কাশ্মীর হচ্ছে পৃথিবীর স্বর্গ’। তারপরে তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কাশ্মীর ভ্রমণে আমাদের জন্য ভিসার প্রয়োজন হবে কি?’ কাশ্মীর সম্পর্কে তার প্রশ্ন আমার নিজের বিশ্বাসকে পরিতৃপ্ত করেছে। কেননা কাশ্মীর সাংস্কৃতিক, ঐতিহাসিক এবং রাজনৈতিকভাবে একটি পৃথক সত্তা যা ভারত জোরপূর্বক দখল করে রেখেছে।

ভদ্রমহিলা কাশ্মীরে রাজনৈতিক অবস্থার ওপর একটি ভীতিজনক স্বরে জিজ্ঞাসা করতে শুরু করলে আমাদের কথোপকথন খুব বেশিক্ষণ দীর্ঘ হয় নি। তার কাল্পনায়, কাশ্মীরে অস্ত্রশস্ত্রে পরিপূর্ণ এবং শ্মশ্রুধারী দানবেরা অমুসলিমদেরকে হত্যা করে থাকে।

এই অবস্থায় মুসলমানদেরকে প্রায়শই সন্ত্রাসী হিসেবে মনে করা হয় যা পাশ্চাত্যে কেবল মুসলমানরা এধরনের প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়। তাদের মত কাশ্মীরি মুসলিমরাও ভারতে এধরনের প্রশ্নের সম্মুখীন হচ্ছে। মুসলিমদের নেয়ে এই মিথ্যা ও নেতিবাচক ধারণা কেবল একটি ওয়েস্টার্ন আমদানি নয়; এটা দূরদূরান্তেও ছড়িয়ে পড়েছে।

তার প্রশ্নে এটা স্পষ্ট যে, কাশ্মীর ভারতের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ বলে দেশটি যে দাবি তুলেছে তা আন্তর্জাতিকভাবে প্রতিষ্ঠা করতে ব্যর্থ হয়েছে। অন্য কথায়, কাশ্মীর সম্পর্কে ভারতের সরকারি আখ্যান ও ভারতের জনগণের জ্ঞান পুরোপুরি ভিন্ন।

আমরা কাশ্মীরি। আরব, ইরানি, তুর্কি কিংবা ভারতীয় নই। আমরা হচ্ছি কাশ্মীরি এবং এটা একটি স্বীকৃতি যে, আমাদের নিজেদের নিজস্ব পরিচয় এবং আখ্যান রয়েছে। আমরা আমাদের মনোভাব অর্থপূর্ণভাবে বিশ্বের সঙ্গে শেয়ার করতে পারি।

লেখক ইনশা মালিক। তিনি নিউ দিল্লির জওয়াহর লাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয়ের পিএইচডি’র ছাত্রী। তার জন্মগ্রহণ এবং বেড়ে ওঠেন কাশ্মীরে সশস্ত্র বিদ্রোহী অস্থিতিশীলতার মধ্যে। ইনশা সক্রিয়ভাবে কাশ্মীরি জনগণের সমস্যা নিয়ে মুখর রয়েছেন বিশেষত কাশ্মীরি নারীদের নিয়ে।

পিএনএস/আলআমীন

@PNSNews24.com

আপনার মন্তব্য প্রকাশ করুন