‘লাশের’ কাছে খোলা চিঠি

  02-03-2024 09:55AM


পিএনএস ডেস্ক: দিনটি এখনো স্পষ্ট মনে করতে পারি। সকাল সকাল অফিস। সাভারে ভবন ধস। একের পর এক বের হচ্ছে লাশ। নিউজরুমে তখনও দিনের ব্যস্ততা শুরু হয়নি। অনলাইনে রিপোর্ট দিচ্ছি। সবার মুখ গম্ভীর। সহকর্মী সিফাত লীনার চোখের জল আমাদের আরও আবেগাপ্লুত করে তোলে। স্বজন হারানোর বেদনা অনুভব করি সবাই। এ দুর্ঘটনা পরে পরিচিতি পায় রানা প্লাজা ট্র্যাজেডি নামে।

অসহায় সে সময়ে লিখেছিলাম, সভ্যতার মুখোশ সেলাই করতো ওরা। ওরা কেউ আমার মা, কেউ বাবা, কেউ ভাই কেউবা বোন। ওরা আটকে পড়েছে রানা প্লাজা নামে এক মৃত্যুপুরীতে। একদিন আগেও ওদের নাম ছিল। কারও নাম আসমা, কারও নাসিমা, কারও জয়নাল। এখন ওদের নতুন নাম হয়েছে ‘লাশ’।

১৯ বছর ধরে এ পেশায় আছি। জীবনের প্রায় অর্ধেকটা সময়। আনন্দ-বেদনার মহাকাব্য। ক্ষমতার পালাবদল। উত্থান-পতন। ভালো সময়, মন্দ সময়। কত ঘটনারই না সাক্ষী হলাম। নীরবে, সরবে। কিন্তু সবচেয়ে কঠিন সময়? কখন কলম, কিবোর্ড চলেই না? কখন রাত হয়ে পড়ে নির্ঘুম। কিংবা কখন নীরবে চোখের পানি পড়ে কিবোর্ডে। কখন আর লেখা এগুতেই চায় না। এখন যেমন হচ্ছে। সকাল ধরে চেষ্টা করছি। কখনও চোখের পানি আটকানো যাচ্ছে, কখনও যাচ্ছে না। কত রিপোর্ট এরই মাঝে ভাসছে টিভিতে, পত্রিকায়, অনলাইনে, ফেসবুকে। ওদের জীবনের কত গল্প ছিল, হাসি, খুশি, প্রাণবন্ত। আনন্দময় সময় কাটাতে গিয়েছিল রেস্টুরেন্টে। আধুনিক মানুষের জীবনের অপরিহার্য এক অনুসঙ্গ। অন্তত কূপের মতো এই শহরে। মুহূর্তের মধ্যে এতোগুলো মানুষের পরিচয় পাল্টে গেল। তাদের নতুন পরিচয় হলো ‘লাশ’। নিমতলী, রানা প্লাজা, চুড়িহাট্টা, বেইলি রোড। আমাদের দুঃসহ বেদনার দিবারাত্রী।

বৃহস্পতিবার রাত। দশটার কিছু পরে বেইলি রোডে আগুনের খবর পেলাম। শুরুতে খুব বড় কিছু মনে হয়নি। টুকটাক আগুনের খবরতো এই নগরীতে মাঝে-মধ্যেই পাওয়া যায়। কিন্তু রাত বাড়তে থাকে। বাড়তে থাকে শঙ্কা। বেইলি রোড থেকে আমাদের সহকর্মী ফাহিমা আক্তার সুমি, জীবন আহমেদ, ঢাকা মেডিকেল থেকে আল আমিন একের পর এক জানাতে থাকেন দুঃসংবাদ। রাত তিনটা-চারটা পর্যন্ত নগর সম্পাদক লুৎফর রহমানের সঙ্গে আলাপ চলতে থাকে। অনলাইনে আপডেট। স্পটে যোগ দেন মারুফ হাসান, হুমায়ূন কবির মাসুদ, সুদীপ অধিকারী।

দিনের শুরুতে চোখটা কিছুটা বন্ধ হয়ে আসে। সকাল সকাল প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরীর সঙ্গে আলাপ করি। দিনের কাজের ব্যাপারে নির্দেশনা দেন তিনি। আটটার কিছু পর মাসুদের ফোন, ভাই আমার বন্ধু মারা গেছে। তখন বুঝতে পারিনি বন্ধুটা কে? কিছুক্ষণ পর পিয়াস সরকারের ফেসবুক স্ট্যাটাসে খোলাসা হয়। তুষার হাওলদার। ড্যাফোডিল ইউনিভার্সিটির সাংবাদিকতা বিভাগ থেকে অনার্স শেষ করেছে মাস কয়েক আগে। ১০ই মার্চ বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন ঘিরে বন্ধুদের সঙ্গে নানা পরিকল্পনা করছিল। মাসুদ ছাড়াও সহকর্মী আইরিন আঁচল ওর বন্ধু, ক্লাসমেট। প্রাণোচ্ছ্বল এক তরুণ। সোশ্যাল মিডিয়ায় তার উপস্থিতি দেখতাম প্রায়ই। জীবনীশক্তিতে ভরপুর। সাংবাদিকতাও করেছে। এমন একটি ছেলে হঠাৎ নাই হয়ে গেল। দিন বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মৃত্যুর তালিকায় আরেক সাংবাদিকের নাম। অভিশ্রুতি শাস্ত্রী। পরিচয় ছিল না। তারপরও মনে হলো আমাদের এক স্বজন। আরেক সহকর্মী কাজী সুমনের আত্মীয় সৈয়দ মোবারক হোসেন কাউছার। ইতালি প্রবাসী। সহসাই পরিবারের সদস্যদের নিয়ে যাওয়ার কথা ছিল ইতালিতে। কিন্তু পরিবার সমেত মারা গেলেন বেইলি রোডের অগ্নিকূপে।

দিনের পর দিন, বছরের পর বছর। ট্র্যাজেডির পর ট্র্যাজেডি। আমরা লিখে যাই। কখনও মৃতদের কাছে খোলা চিঠি। এ চিঠি তাদের কাছে পৌঁছাবে না জেনেও। পরিস্থিতির কোনো পরিবর্তন হয় না। জোরদার হয় না অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা। বিল্ডিং কোড মানার জন্য বাধ্য করা হয় না ক্ষমতাবানদের। এতো এতো উন্নতির পরও ফায়ার সার্ভিসকে সর্বোচ্চ সক্ষম করতে পারি না আমরা। প্রতিটি দুর্ঘটনার পর কয়দিন আলাপ-আলোচনা চলে। ফেসবুকে চলে উজির-নাজির মারা। কত লোক মারা গেল ক্যালকুলেটরে চলে হিসাব-নিকাশ। আদতে কিছ্ইু বদলায় না।

ফেসবুকে বন্ধু পলাশ সরকারের লেখা পড়ছিলাম, ‘মৃত মানুষের কাছে কোনো তদন্ত কমিটি, শোকজ, শাস্তিমূলক ব্যবস্থা, শোক, বিবৃতি কিছুই পৌঁছাবে না। তাই অবহেলাজনিত দুর্ঘটনার পর এইসব করার জন্য করা কাজ আসলে মূল্যহীন। তারচেয়ে বরং এমনভাবে কাজ করা উচিত যেন এই নগরীতে আর কেউ এভাবে পুড়ে না মরে। কিন্তু এটা কেউ করবে না। কারণ এই দেশে দায়িত্বশীলদের কাজই হলো কোনো সমস্যার গভীরে না যেয়ে, শুধুমাত্র লোক দেখানোর জন্য যতটুকু না করলেই নয়, তা-ই করে। খেয়াল করলে দেখা যায় প্রতিটি ঘটনার পর কয়দিন খুব আলোচনা হবে। কর্তাব্যক্তিরা কথার বারুদ ফাটাবে। অনেক আইন হবে। কানুন হবে। পোড়া মাংসের গন্ধ হাওয়ায় মিলিয়ে যাবে, আমরাও সব ভুলে যাবো। কিন্তু কোনো একটি প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তি দিনের পর দিন কঠোরভাবে এই সব অনিয়ম আর লোভের বিরুদ্ধে লেগে থাকবে না। আবার নতুন কোনো ঘটনা ঘটার আগ পর্যন্ত আমরা সব ভুলে থাকবো।’


এবারের ট্র্যাজেডির পরও যথারীতি কৌতুকজনক খবরটি পাওয়া গেল। রাজউক জানিয়েছে, বেইলি রোডের ভবনটিতে রেস্তোরাঁ করার অনুমোদন ছিল না। লোভ, অব্যবস্থাপনা, অনিয়ম। বলি এতোগুলো মানুষ। লাশ গোনাই যেন আমাদের কাজ। দায় কার? দায়িত্ববানদের সবচেয়ে বেশি। অল্প অল্প সবারই। আমরাই গড়ে তুলেছি এই নগর। এই মহূর্তে মৃতদের জন্য প্রার্থনা আর ক’ফোটা চোখের জল। এছাড়া আর কী-ই বা করতে পারি!


পিএনএস/আনোয়ার


@PNSNews24.com

আপনার মন্তব্য প্রকাশ করুন