আওয়ামী লীগের কাউন্সিল থেকে গণতন্ত্রের শতফুল ফুটুক

  23-10-2016 08:45AM



পিএনএস ডেস্ক: বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ২০তম জাতীয় কাউন্সিলকে ঘিরে সারা দেশে দলের নেতাকর্মীদের মধ্যে উৎসাহ-উদ্দীপনার পাশাপাশি আওয়ামী ঘরানার বাইরের সমাজ ও রাজনীতিসচেতন মানুষের ভেতরও এক ধরনের আশাবাদ জাগ্রত হয়েছে। দলের মূল নেতৃত্বকে কাউন্সিলকেন্দ্রিক সাজসাজ রব ও আনন্দ-উল্লাসে তৃপ্তির ঢেঁকুর না তুলে জনগণের আশাবাদকে গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করতে হবে। মনে রাখতে হবে, আমাদের মতো দুর্নীতিপ্রবণ একটি দেশে একটানা পৌনে আট বছর ক্ষমতা ভোগকারী একটি দলের জাতীয় সম্মেলনকে কেন্দ্র্র করে দেশব্যাপী উৎসব আয়োজনের আলাদা একটা ‘শানে-নজুল’ও আছে। দল থেকে কড়া নির্দেশবাণী ছড়িয়ে দেয়া হয়েছে, এ উপলক্ষে কোনো প্রকার চাঁদাবাজি-তোলাবাজি চলবে না। বলা হয়েছে, কাউন্সিলের সব খরচ বহন করবে দল। সে তো কাউন্সিলের দু’দিনের যাবতীয় খরচ। পোস্টার, ব্যানার, প্রচারসামগ্রী, খাবার-দাবার এর মধ্যে পড়বে। কিন্তু নেতারা কি খবর নিয়েছেন, জেলায় জেলায়, শহরে-নগরে-বন্দরে, থানায় থানায় এমনকি অনেক গ্রামেও সম্মেলনকে কেন্দ্র করে কী পরিমাণ উৎসব-আনন্দের সাজ-সজ্জার আয়োজন হয়েছে? দু’দিনে কাউন্সিল বাবদ যে বাজেট বরাদ্দের কথা শোনা যাচ্ছে, বাইরের আয়োজনে খরচ হচ্ছে তারচেয়ে বহু গুণ। কেউ কেউ বলেন শত গুণ। এ টাকা কোত্থেকে আসছে? রাজনৈতিক দলে এখন এমন দিলদরিয়া লোক কোথায় ক’জন আছেন যে, নিজের লাভালাভি ছাড়া দলের জন্য কোটি টাকা খরচ করবেন? প্রকৃত ও নিবেদিতপ্রাণ নেতা-কর্মী-সংগঠক-সমর্থকদের উৎসাহ-উদ্দীপনার প্রতি সম্মান দেখিয়েও বলা যায়, এর কিন্তু একটা নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া আছে। ঢাকা মহানগরীর অনেক এলাকাতেও বিভিন্ন নামে দলের জাতীয় কাউন্সিল উপলক্ষে লাখ লাখ টাকা খরচ করে চোখ ঝলসে দেয়া আয়োজন লক্ষ করা যায়। ভূত-জিন তো এসব খরচ জোগায়নি। এসবে আওয়ামী লীগের লাভের চেয়ে ক্ষতির সম্ভাবনা থেকে যায়। এই জাতীয় কাউন্সিল থেকে আওয়ামী লীগের ভালো অর্জন হতে পারে জনগণের প্রত্যাশার মর্যাদা দিলে। বিশ্বাস করতে চাই, দলের ‘মূল নেতৃত্ব’ বিষয়টি অবশ্যই মাথায় রাখবেন।

এটা অবশ্যই স্বীকার করতে হবে যে, গত দু-তিনটি কাউন্সিল থেকে আওয়ামী লীগের ২০তম জাতীয় কাউন্সিল রাজনৈতিক-সাংগঠনিক চরিত্র লাভ করেছে। একটি রাজনৈতিক দলের জাতীয় কাউন্সিল বা সম্মেলন যেসব কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে পরিপূর্ণতা লাভ করে, এবার তার সবগুলোই অনুসরণ করা হচ্ছে। সময় বদলেছে, দেশে মানুষ বেড়েছে- অর্থাৎ ভোটার বেড়েছে। তার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে সংগঠনের নেতৃত্ব কাঠামোর পরিধি বাড়ানোর প্রয়োজনও দেখা দিয়েছে। এবার দলের সভাপতিমণ্ডলীতে ৪ জন সদস্য বাড়ানোর কথা শোনা যাচ্ছে। প্রস্তাবটি নাকি দলীয় সভানেত্রীর। ভালো লাগছে এই শুনে যে, দলীয় সভানেত্রী তার ইচ্ছা অনুযায়ী এই সদস্য সংখ্যা বাড়িয়ে দেননি, দিলে কোনো অসুবিধা ছিল না। নিশ্চয়ই সবাই মেনে নিত। কিন্তু তা না করে তিনি তার প্রস্তাব সংশ্লিষ্ট উপ-কমিটিতে পাঠিয়েছেন এবং উপ-কমিটি তা গ্রহণ করে খসড়া প্রস্তাবাকারে পেশ করেছে নির্বাহী কমিটির কাছে। তারা অনুমোদন করলে তা কাউন্সিলে পেশ করা হবে এবং পাস হলে তা বাস্তবায়ন হবে। অন্যান্য সাংগঠনিক বিষয়েও একই প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হচ্ছে। এটি সম্পূর্ণই একটি গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া। এভাবেই একটি দলে গণতন্ত্রের চর্চা ও অনুশীলন বাড়ে। এই প্রক্রিয়া যদি কাউন্সিল শেষেও বিভিন্ন সাংগঠনিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রেও অনুসরণ করা হয়, তাতে আওয়ামী লীগ লাভবান হবে। অন্যান্য রাজনৈতিক দলও দলের সাংগঠনিক বিষয়াবলীসহ সব ক্ষেত্রে এ ধরনের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া অনুসরণে উদ্বুদ্ধ হতে পারে।

দলের আগামী ২০২১ ও ২০৪১ সালের রূপকল্প নিয়েও কাজ হচ্ছে। বিশেষ করে ভিশন ২০৪১ প্রণয়নের কাজ সম্পন্ন করা হয়েছে এবং তা কাউন্সিলে অনুমোদনের উদ্যোগ নেয়া হবে আলাপ-আলোচনা শেষে। ২০তম এই জাতীয় কাউন্সিল উপর থেকে কোনো সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেয়ার সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসছে বলে মনে হয়। এ লক্ষণ অবশ্যই শুভ। এর বাইরেও আশাবাদ আছে দলের ও বাইরের জনগণের। এর আগে কাউন্সিলে শুধু দলীয় সভানেত্রীর বিষয়টিই উত্থাপিত হতো। তিনি বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হতেন এবং বাদবাকি সব পদে নিয়োগদানের বিষয়টি সভানেত্রীর ওপর ছেড়ে দেয়া হতো। এবার নানা ক্ষেত্রে গণতন্ত্র চর্চার চেষ্টা যখন করা হচ্ছে, প্রত্যাশা হচ্ছে অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ পদেও সারা দেশ থেকে আসা কাউন্সিলরদের মতামতের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত গৃহীত হবে। অন্তত সাধারণ সম্পাদক, সভাপতিমণ্ডলী, উপদেষ্টামণ্ডলীসহ গুরুত্বপূর্ণ পদসমূহে কাউন্সিলরদের মতামতের ভিত্তিতে কাউন্সিলেই নিয়োগ ঘোষণা করা হবে। আওয়ামী লীগের এই কাউন্সিলে দলের সাংগঠনিক বিষয়াবলী, রাজনৈতিক লক্ষ্য নির্ধারণ ও কমিটি গঠনের বাইরেও প্রত্যাশা হচ্ছে, এই কাউন্সিলে শুধু দলের অভ্যন্তরেই নয়, রাষ্ট্র পরিচালনার সব প্রক্রিয়ায়, অন্যদের সাংবিধানিক রাজনৈতিক অধিকার সংরক্ষণে, সর্বোপরি বহুদলীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে লালন ও শক্তিশালীকরণে ‘প্রকৃত গণতন্ত্র’ ও সুশাসন প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকারও ব্যক্ত হবে।

২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির বিতর্কিত ও দেশে-বিদেশে আদর্শ নির্বাচন নয় বলে কঠোরভাবে সমালোচিত দশম সংসদ নির্বাচনের নেতিবাচক ভাবমূর্তি দূর করে একটি সব দলের অংশগ্রহণমূলক, অবাধ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানের অঙ্গীকার ব্যক্ত করাও জরুরি। যেহেতু দল শাসন ক্ষমতায় এবং ক্ষমতার উৎসের দুর্বলতা আছে, তা কাটানোর জন্যও আওয়ামী লীগকে জনগণের আস্থা ও বিশ্বাস অর্জনকারী অনুকূল সিদ্ধান্ত নিতে হবে। দেশে এখন গণতান্ত্রিক শাসনের স্থলে আওয়ামী লীগের একদলীয় শাসনই চলছে কার্যত। সংসদ প্রশ্নবিদ্ধ ও বিরোধী দলহীন। একটি মর্যাদাশীল সংসদ গঠন এই কাউন্সিলের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক অঙ্গীকার হওয়া উচিত। আওয়ামী লীগ এখন সরকারে। দেশে গণতন্ত্র ও সুশাসন প্রতিষ্ঠায় তাদের দায়িত্ব বেশি। অন্যের মৌলিক অধিকার ভোগের পথে যত অন্তরায় আছে তা অপসারণের দায়িত্ব নিতে হবে তাদের। দেশে শাসক দলের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড ছাড়া অন্যদের কার্যক্রম নানাভাবে বাধাগ্রস্ত। প্রকৃত বিরোধী দল বিএনপিসহ অন্যরা মাঠেই নামতে পারে না। মামলা-মোকদ্দমায় তারা জর্জরিত। গ্রেফতার, গুম ও হত্যায় আতংকিত। দীর্ঘদিন মানুষের ও রাজনৈতিক দলসমূহের সংবিধানস্বীকৃত মৌলিক অধিকারগুলো অবরুদ্ধ করে রাখলে তার পরিণতি কখনও কোথায়ও শুভ হয়নি। এটি মনে রেখে দলের এই কাউন্সিলে সিদ্ধান্ত গহীত হবে বলে প্রত্যাশা করছেন অনেকে। তা না হলে সারা দেশে কাউন্সিল ঘিরে দলের ‘রঙিন খেলা, রঙিন মেলা’ কোনো কাজেই লাগবে না।

আওয়ামী লীগের এই কাউন্সিল ঘিরে এত প্রচার, এত কিছু, কিন্তু ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন এ দলটি যিনি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন সেই মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানীকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করা হয়েছে। এটা হীনমন্যতা। তিনি দীর্ঘ ৮ বছর একটানা দলের সভাপতি ছিলেন এবং যতদিন ছিলেন, ছিলেন অপ্রতিদ্বন্দ্বী। তার প্রতি অবহেলা-অবজ্ঞা রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা ভালো চোখে দেখছেন না। কী এমন ক্ষতি হতো মওলানা ভাসানীকে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করলে? লাভ তো হতো আওয়ামী লীগের।

বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া এবং দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে আওয়ামী লীগের কাউন্সিলে। এটি একটি ভালো সিদ্ধান্ত। সবাই আশা করেছিলেন বিএনপি এ কাউন্সিলে যোগ দেবে। আমন্ত্রণপত্র গ্রহণকালে মির্জা ফখরুল যদিও বলেছিলেন, দলীয় ফোরামে আলোচনা করে এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে, তবে ধারণা করা হয়েছিল সিদ্ধান্তটি অনুকূলই হবে। এর আগে এ কাউন্সিলের সাফল্য কামনা করে তিনি যে বক্তব্য দিয়েছিলেন তা সর্বমহলে প্রশংসিতও হয়েছিল। কিন্তু আমন্ত্রণে সাড়া না দিয়ে বিএনপি সম্পর্কোন্নয়নের পথই রুদ্ধ করে দিল। জামায়াতে ইসলামীর দাওয়াত কবুল করতে দলের কেউ আপত্তি করে না, আওয়ামী লীগের কাউন্সিলে অতিথি হতে আপত্তি কেন? এর মাধ্যমে বিএনপি আসলে কী বার্তা দিল? বেগম জিয়ার উচিত ছিল কাউন্সিলে গিয়ে দু’দলের, বিশেষ করে দুই নেত্রীর দূরত্ব ও বৈরী সম্পর্ক অবসানের একটা পরিবেশ তৈরি করা। এতে সারা দেশে দুই দলের তৃণমূল স্তর পর্যন্ত নেতা-কর্মী-সংগঠকদের মধ্যে একটি নবদিগন্ত উন্মোচিত হতো। শেখ হাসিনার দাওয়াত গ্রহণ না করে বেগম জিয়া আবারও রাজনৈতিক পয়েন্ট অর্জনে পিছিয়ে পড়লেন।

আওয়ামী লীগের জাতীয় কাউন্সিলের মাধ্যমে জনগণের প্রত্যাশিত গণতন্ত্রের শতফুল ফুটুক, তার সুরভি ছড়িয়ে পড়ুক দিগ্বিদিক।

কাজী সিরাজ : সাংবাদিক ও কলামিস্ট


পিএনএস/আনোয়ার

@PNSNews24.com

আপনার মন্তব্য প্রকাশ করুন