শারীরিক সম্পর্ক স্থাপনের জন্য প্রেমের ভাণ করা বড় ধরণের প্রতারণা

  25-01-2018 06:12PM

পিএনএস (সিফাত বিনতে ওয়াহিদ) : 'প্রেম' সম্পর্কে আমাদের সমাজে নানা ধরণের ট্যাবু প্রচলিত আছে। এখনো আমাদের সমাজে প্রেম করে দুজন নর-নারীর পথচলাকে কটুদৃষ্টিতে দেখা হয়। আগে গ্রাম থেকে শহর যে কোনো স্থানেই কেউ বিয়ে করলে, প্রশ্ন করা হতো- 'লাইন করে বিয়ে করছে?' এই লাইন মানে প্রেম, লাইন মানে সংযোগ। দুজন মানুষের মধ্যে সংযোগ না থাকলে সেটা এক ধরণের সমঝোতা হয়ে থাকে, যে সমঝোতা সারা জীবন বয়ে নিয়ে যেতে হয়। হ্যাঁ, পারিবারিকভাবে বিয়ে হলেও যে মানুষ অসুখী থাকছে, তা নয়। বরং আমাদের নানা-নানী, দাদা-দাদীরা বিয়ের আগে বর-কনে লাইন করা দূরে থাক, দেখারও সুযোগ পেতেন না। আবার প্রেমের বিয়েও যে খুব একটা টিকে যাচ্ছে, সেটাও কিন্তু নয়। বরং হিসাব করলে দেখা যাবে, প্রেমের বিয়েরগুলোই এখন বেশি ভাঙনের পথে পা বাড়াচ্ছে। এর কারণ মানসিক অস্থিরতা, পরস্পরের প্রতি আস্থা হারানো, শ্রদ্ধা এবং বিশ্বাস কমে যাওয়া।

'প্রেম' দোষের কিছু না, বরং 'প্রেম' সম্পর্কে আমাদের ধারণা পরিষ্কার থাকা জরুরি। এমন কি পরকীয়ার বিষয়টাতেও ছিঃ ছিঃ করার কিছু নেই বরঞ্চ দুইজন নর-নারীর একসঙ্গে থাকার জন্য সামাজিক স্বীকৃতির প্রয়োজনটাই অশ্লীল মনে হয়। আমি বলছি 'প্রেম' সম্পর্কে স্পষ্ট থাকো। কারোর জন্য প্রেম থাকলে প্রকাশ করো কিংবা গোপন রাখো, দুজনের সম্মতি থাকলে কোনো কিছুতেই কোনো সমস্যা থাকার কথা না। তাছাড়া প্রেম তো যে কোনো বয়সে, যে কারোর সঙ্গেই হতে পারে। এটা তো সম্পূর্ণ মনের বিষয়। একজনের মন, যে কারোর সংস্পর্শে আন্দোলিত হতে পারে।

বিখ্যাত রাশিয়ান-আমেরিকান ঔপন্যাসিক ভ্লাদিমির নবোকভের উপন্যাস 'ললিতা'য় আমরা দেখতে পাই, হামবার্ট নামের এক মধ্যবয়স্ক ভদ্রলোক প্রেমে পড়েন তার স্ত্রীর আগের ঘরের কন্যার। একজন বিবাহিত মধ্যবয়স্ক পুরুষের সাথে একটি অল্প বয়সী বালিকার প্রেমের ঘটনা এই উপন্যাসটির মূখ্য উপাদান হলেও এতে রয়েছে জীবনের সুখ ও ট্র্যাজেডির আশ্চর্য সৌন্দর্য। এমন নিদর্শন পৃথিবীতে অহরহ। প্রেমের টানে পৃথিবীতে যুদ্ধের নিদর্শনও কম নই।

কিন্তু প্রেম না থাকলে; মানসিক আকর্ষণ না বোধ করলে, শুধুমাত্র কিছু সময় কাটানোর জন্য বা শারিরীক সম্পর্ক স্থাপনের জন্য প্রেমের ভাণ করা, প্রতিশ্রুতি দেওয়া, অভিনয় করা- বড় ধরণের প্রতারণা। সময় তো কাটানো যায় বন্ধুর সঙ্গেও, প্রেম না থাকলেও তো যে কোনো প্রাপ্ত বয়স্ক দুজন পারস্পরিক সম্মতির মাধ্যমেও শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন করতে পারেন। ফলে প্রেমে না পড়েও বিশেষ উদ্দেশ্যে কারোর সঙ্গে প্রেমের ভাণ করাটা বিরাট ধরণের হিপোক্রেসি।

যে কোনো ব্যক্তিকে আগে নিজের ব্যাপারে সৎ হতে হয়, নিজের চাওয়া সম্পর্কে পরিষ্কার জ্ঞান থাকতে হয়, শুধুমাত্র তখনই সে অন্য সম্পর্কগুলোর ক্ষেত্রেও সৎ থাকতে পারেন, শ্রদ্ধাশীল হতে পারেন। প্রতিটা সম্পর্কের ক্ষেত্রেই ভেবে-চিন্তে সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত। কোনো নারী বা পুরুষ নিঃসঙ্গতার গল্প শোনালেই তার জন্য বুক পেতে দিতে হবে কেন? হাত বাড়িয়ে তার বন্ধু হওয়া যায় বড় জোর।

তাছাড়া পারস্পরিক বিশ্বাস না থাকলে আদৌ কোনো সম্পর্কই দীর্ঘস্থায়ী হয় না। দুজন ব্যক্তির সম্পর্ক চলাকালীন সময়ে নিজেদের মধ্যে ব্যক্তিগত কথাবার্তা, সম্পর্ক ভেঙে যাওয়ার পর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোর মতো স্থানে সেগুলো প্রকাশ করা এক ধরণের নোংরামি, খুবই সস্তা মানের কাজ। এতে অপরকে ছোট করতে গিয়ে বরং নিজের হীনমন্যতারই পরিচয় দেওয়া হয়। প্রেম কী এতটাই ঠুনকো হয় যে, কোনো কারণে একসাথে থাকতে না পারলেই প্রতিশোধ নিতে হবে? বরং এই না থাকতে পারাটার মধ্যেও তো নিজেদের শ্রদ্ধা প্রদর্শন করা সম্ভব, নয় কী?

প্রত্যেকেরই প্রেম সম্পর্কে আরো গভীরভাবে ভাবা উচিত। একটা মানুষ যদি সত্যি সত্যিই প্রেমে পড়ে, প্রেমিক বা প্রেমিকা ছাড়া, অন্য মানুষকে নিয়ে ভাবার সময় থাকার কথা না তার। সে অন্য কাউকে নিয়ে ভাববে কখন? একটা মানুষের জীবনে প্রতিদিন একটাই বিকাল আসে যখন প্রেমিক-প্রেমিকাকে মনে করা যায়, একটাই সন্ধ্যা আসে যখন একজন আরেকজনের হাত ধরে বসে থাকা যায় কিংবা পাশে না থাকলেও সেই মুহূর্তটার কথা কল্পনার রঙ তুলিতে এঁকে নেওয়া যায়। কীভাবে এ সময়গুলো অন্য কারোর পেছনে ব্যয় করা সম্ভব হয়ে উঠে? প্রতিটা সম্পর্কেই মানুষকে সৎ থাকা প্রয়োজন, আর এটা চাইলেই সম্ভব।

প্রেম নিয়ে আরো ভাবার সময় এসেছে, যা ইচ্ছা তাই প্রেম বলে চালিয়ে দিলে হবে? আবার যা ইচ্ছা তাই করার উদ্দেশ্যে যে কোনো কিছুকে প্রেম বললে চলবে? প্রখ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাতা ঋত্বিক ঘটক বলেছিলেন, 'ভাবো, ভাবো, ভাবা প্র‍্যাক্টিস করো।' আমরা ভাবি কম, সরাসরি অ্যাকশনে যেতে পছন্দ করি- এটাই মূল সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে।-পূর্বপশ্চিম.কম

পিএনএস/জে এ /মোহন

@PNSNews24.com

আপনার মন্তব্য প্রকাশ করুন