অনাথ শহর ঢাকা

  25-04-2018 09:22PM

পিএনএস (মোস্তফা মামুন) : কলম্বোতেই সম্ভবত, একবার বেড়াতে গিয়ে আমাদের এক সহকর্মীর মানিব্যাগ হারিয়ে গেল। তাতে ডলার আছে অনেক, কাজেই ফিরে পাওয়ার কোনো সম্ভাবনাই কেউ দেখতে পাচ্ছে না।

একজন শুধু একটু দেখতে পেল। ক্ষীণ গলায় বলল, ‘কাল আমরা ওই জায়গায় গিয়ে আবার খুঁজে দেখতে পারি।

একটা সম্ভাবনা আছে।’‘সম্ভাবনা আছে! কিভাবে?’ আমরা বেশ বিস্মিত।‘এটা তো আর আমাদের ঢাকা শহর না। টাউট-বাটপাড়ের সংখ্যা অত বেশি হওয়ার কথা না।’

নিজের শহরকে এমনভাবে উপস্থাপন করা একটা লজ্জার ব্যাপার। আমরা কেউ লজ্জা পেলাম না। বরং জায়গাটা ঢাকা নয় বলে, ওখানে বাজে লোকের সম্ভাব্য সংখ্যা ঢাকার চেয়ে অনেক কম ধরে নিয়ে ঠিকই আশাবাদী হয়ে উঠলাম।

ঘটনাও ঘটল সে রকম। পরদিনই মানিব্যাগটা নিজে থেকে হাজির। যে ভাড়ার গাড়ির ড্রাইভার আমাদের নিয়ে গিয়েছিল, সকালবেলা বিব্রত ভঙ্গিতে সে উপস্থিত। লজ্জা পাওয়া গলায় বলল, ‘দুঃখিত যে তোমাদের সারা রাত টেনশনে থাকতে হয়েছে। আমি বাড়িতে পৌঁছে জিনিসটা দেখেছি। বাড়ি অনেক দূর বলে অত রাতে আর ফিরিয়ে দিতে আসতে পারিনি।’

আমরা মানিব্যাগ ফেরত পেয়ে উচ্ছ্বসিত। আর ড্রাইভারের লজ্জাবোধ দেখে স্তম্ভিত। সে চলে গেলে আবার তুলনায় মেতে উঠলাম। ঢাকার কোনো ড্রাইভার হলে এই টাকা নিয়ে কী কী করত সেই নিয়ে কত রকম যে রসিকতা! সেবার ফেরার সময়ও খুব ঝামেলা হলো।

এয়ারপোর্টে নামার পরই কাস্টমস কর্তারা এমনভাবে ঝাঁপিয়ে পড়লেন, যেন আমরা বিদেশ থেকে বড় কোনো পাপ করে এসেছি। সাংবাদিক পরিচয়ের কিছু দাপট দেখিয়ে ওখান থেকে পার পাওয়া গেল; কিন্তু বাইরে বেরিয়ে আরেক সমস্যা। সঙ্গে বড় লাগেজ ছিল বলে ট্যাক্সিওয়ালা ১০০ টাকার ভাড়া চেয়ে বসল ৫০০ টাকা।

সেই কালো ট্যাক্সি আবার মাঝপথে এসে বিগড়ে গেল। মহাখালীর কাছাকাছি এসে নেমে গাড়ি ঠেলতে হলো কিছুক্ষণ। সেই সময় আবার ট্রাফিক পুলিশ এগিয়ে এসে ড্রাইভারের লাইসেন্স দেখতে চাইল। তর্ক-বির্তক চলল অনেকক্ষণ, শেষে ১০০ টাকায় মীমাংসা হলো।

ঢাকার রাস্তায় এটা খুব সাধারণ একটা অভিজ্ঞতা। কিংবা কখনো কখনো আরো অনেক বেশি তিক্ত। একজন সাধারণ চাকরিজীবীর দিনটা শুরু হবে রাস্তায় বেরিয়ে গাড়ি না পাওয়া দিয়ে। ভিড়ে ভর্তি সব গাড়ি, অনেক ঠেলেঠুলে হয়তো গাড়িতে ওঠা গেল। সেখানে ভাড়া নিয়ে বচসাও প্রায় দৈনন্দিন একটা ব্যাপার। তারপর ট্রাফিক জ্যামে ১৫ মিনিটের রাস্তা এক ঘণ্টা ১৫ মিনিট লাগবে। ফেরার পথে অবস্থা আরো করুণ। অফিস থেকে ৫টায় বেরিয়ে বাড়ি ফিরতে ফিরতে মোটামুটি ৮-৯টা।

তারপর গাড়ি থেকে নেমে গলিপথে ছিনতাইয়ের শিকার হওয়ারও আশঙ্কা। সেটা পেরিয়ে বাসায় সহিসালামতে ফেরার পর হয়তো নেই কারেন্ট। এভাবে অঘুম-নির্ঘুম কাটিয়ে আবার পরদিনের লড়াইয়ের জন্য তৈরি। এই তিক্ত জীবনটাকে অতি সম্প্রতি আরো তিক্ততর করে দিয়েছে রাস্তাঘাট। ভাবা যায়, যে শহরে এ দেশের প্রায় ১০ শতাংশ মানুষ বাস করে, সরকার-মন্ত্রী, জ্ঞানী-গুণী, ব্যবসায়ী-নায়ক-গায়ক সবাই যে শহরে থাকেন, সেই শহরের বেশির ভাগ রাস্তাঘাটে পা রাখাই দায়? ফ্লাইওভার নির্মাণের নাম করে শহরের বিরাট একটা এলাকা এখন মোটামুটি পরিত্যাজ্য। সামান্য বৃষ্টিতেই সাগর হয়ে যায় আরেকটা বড় অংশ।

সেখানে খানাখন্দে রিকশা ওল্টাচ্ছে, মানুষ খাবি খাচ্ছে, গাড়ির চাকা আটকে যাচ্ছে! আর মূল রাস্তা পেরিয়ে একটু ভেতরে গলিতে ঢুকলেন তো গেলেন। ভাঙা রাস্তা আর তথাকথিত সংস্কারকাজের জন্য খুঁড়ে রাখা গর্ত মিলিয়ে এ যেন নরকের পথেই আপনাকে আমন্ত্রণ।

আবার বৃষ্টিতে উপচেপড়া নর্দমার গন্ধ থেকে বাঁচতে নাকে রুমালের ব্যবহারও অনিবার্য বেশির ভাগ ক্ষেত্রে। দেখে দেখে মনে হয়, এই শহরের আসলে কোনো অভিভাবক নেই। এই শহর সবার, তাই আসলে কারো নয়। একে ভোগ করা যায়, ভালোবাসা যায় না। এর শরীরকে সবার দরকার, এর হৃদয়ের খোঁজ কেউ রাখে না! আমাদের ভালোবাসাহীনতায়ই আসলে এই শহরটা মন-প্রাণ হারিয়ে এমন কুৎসিত। এবং সেই অবহেলার ক্ষোভ থেকেই নৃশংস হয়ে প্রতিশোধ নেয় রোজ।

আমাদের প্রায় সবাইকে কাজে-অকাজে ঢাকার বাইরে যেতে হয়। গিয়ে অবাক হয়ে খেয়াল করবেন, মফস্বল শহরের রাস্তাঘাট অনেক উন্নত। একেবারে সুদূর গ্রামেও চলে গেছে উন্নয়নের জোয়ার। কিভাবে সম্ভব? কৌতূহলবশত গত ঈদের সময় বেড়াতে গিয়ে গ্রামের একজনের কাছে জানতে চেয়েছিলাম।

একটুও না ভেবে বললেন, ‘বলতে পারেন এটাই গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ফেরার একমাত্র সুবিধার দিক।’

‘এখানে আবার কিভাবে গণতন্ত্র এলো?’

‘এখন নির্বাচন হয়, এমপি-মন্ত্রীদের ভোট চাইতে গ্রামে আসতে হয়। আর গ্রামের মানুষ উন্নয়ন বলতে বোঝে রাস্তাঘাট, সেগুলো দেখানোও যায়। তাই জনপ্রতিনিধিরা আর যাই করুন, নিজের এলাকার রাস্তাঘাট ঠিক করার ব্যাপারে একটা ভূমিকা রাখেন। রাস্তা ঠিক না থাকলে পরেরবার ভোট চাইতেই কেউ আসতে পারবেন না। পাবলিক দৌড়ান দেবে।’

বুঝলাম ঢাকার সমস্যা এখানেই। কেউ কাউকে দৌড়ান দেয় না! মফস্বলে প্রতিটি এলাকার জনপ্রতিনিধিদের মানুষ মোটামুটি চেনে, যেমনই হোন তিনিই সেই এলাকার অভিভাবক বলে গণ্য। ঢাকার সেই ব্যাপার নেই। আমরা কয়জন জানি যে আমাদের এলাকার এমপি অমুক!

অন্তত ১০ জনের সঙ্গে কথা বলে দেখেছি, আসন পুনর্বিন্যাসের পর তাঁরা এখন আর ঠিক নিশ্চিত নন যে তাঁরা ঢাকা-৯, নাকি ১৩, না ১৬-র বাসিন্দা। সিটি করপোরেশন দুই ভাগে ভাগ হওয়ার পর উত্তর আর দক্ষিণ নিয়েও আরেক ঝামেলা। এরপর এখন আবার প্রশাসক, সেই প্রশাসকের নাম ঢাকা শহরের শতকরা ৮০ জন লোকই বোধ হয় জানে না। ঢাকা এভাবেই অনাথ এবং অভিভাবকহীন।

আবার আমরা বা নাগরিকদেরও সেই নিয়ে মাথাব্যথা নেই। বেশির ভাগ মানুষই ভাড়াটে বলে খুব সমস্যা হলে বাসা বদলে ফেলছি। যারা সেটা পারছি না, তারা মোটা দাগে সরকারকে গালাগালি করে কাজ শেষ করছি। রাস্তাঘাট বা নাগরিক সুবিধার জন্য যে মিলিত অবস্থান দরকার, সে ব্যাপারটাই তো আমাদের মধ্যে নেই। কাজেই জবাবদিহি করার ব্যাপারটা যাঁদের, তাঁরা নিরাপদেই থাকেন। আর সরকার-নেতা এদের প্রশংসায় গলা ফাটিয়ে চেয়ার টিকিয়ে রাখেন।

অনেক বছর আগে এক বন্ধু বলেছিল, ঢাকা শহর আসলে তিন ভাগে বিভক্ত।

‘তিন ভাগে?’

“একটা ভাগ পুরান ঢাকা থেকে গুলিস্তান পর্যন্ত। এরা ঢাকার আদি বাসিন্দা। এরাই শুধু ঢাকাকে নিজের শহর মনে করে। আরেকটা ভাগ মহাখালী ফ্লাইভার পর্যন্ত। এরা ঢাকায় থাকে বটে; কিন্তু এখনো কেউ ‘সিলেটি’ কেউ ‘নোয়াখালী’ কেউ...। আরেকটা ভাগ গুলশান থেকে শুরু হয়ে ওই দিকটা। এরা ঢাকায় থাকে; কিন্তু এদের মন আসলে বিদেশে। কেউ সিঙ্গাপুর, কেউ ব্যাংকক, কেউ আমেরিকা-কানাডা। ছুটি পেলেই ওখানে ছোটে।”

ভাগটা কতটা ঠিক জানি না; কিন্তু মাঝেমধ্যে মনে হয়, ঢাকায় বছরের পর বছর থেকেও, এখানে জন্ম নিয়েও আমরা ঠিক ঢাকার মানুষ হয়ে উঠি না। ঈদে ছুটির সময় ঢাকা ছেড়ে যাওয়ার যে মিছিল, তাকে নাড়ির টান, মূলের প্রতি ভালোবাসা ইত্যাদি বিশেষণের তোড়ে ভাসিয়ে দিয়ে অন্য পিঠটা আর কেউ খেয়াল করি না।

সারা বছর থেকে, সব প্রয়োজন মিটিয়ে উৎসবের সময় যে শহরটাকে নিঃস্ব আর একা করে দিয়ে যাচ্ছি, সে বোধটাই আমাদের নেই। অনেকে বলবেন, মেট্রোপলিটন সিটির এটাই ভাগ্য। ঠিক। কিন্তু তাহলেও একটা জিনিস ঠিক মেলাতে পারি না। বিদেশের বড় শহরের দ্রষ্টব্য জায়গাগুলোর প্রতি আমাদের কী আকর্ষণ! লন্ডন আই, আইফেল টাওয়ার ইত্যাদির প্রতি আমাদের আকর্ষণের কারণ সেখানকার সাহিত্যে-সিনেমায় জায়গাগুলোকে গভীর ভালোবাসা আর গৌরবের রঙে রঙিন করা হয়; কিন্তু এ ক্ষেত্রেও ঢাকা প্রায় বঞ্চিত। কলকাতায় গিয়ে চৌরঙ্গী-এসপ্লানেড দেখে অনেককে আবেগে আপ্লুত হয়ে যেতে দেখি, যখন ঢাকার বাইরের মানুষ আমাদের সোহরাওয়ার্দী উদ্যান কিংবা ফার্মগেটে এসে ভয় পায়। সাহিত্য-সিনেমায় সেভাবে মহিমামণ্ডিত হয় না, উল্টো পত্রিকার খবরে দেখে এখানে নানান অপকর্ম হয়।

এগুলো তাই ঘৃণা আর ভীতির জায়গা। এক ড. মুনতাসীর মামুন বাদ দিলে ঢাকার ইতিহাস-ঐতিহ্য নিয়ে কি আন্তরিক কাজ করেন কেউ?

মাঝেমধ্যে সেমিনার-টেমিনার হয় অবশ্য। ঢাকাকে বাসযোগ্য করতে এই পরিকল্পনা, সেই পরিকল্পনা! কিন্তু সেগুলোর সঙ্গে আবার মানুষ নেই। এখনো বহু মানুষকে দেখি ঢাকায় কিছু একটা হচ্ছে শুনে খুশি হওয়ার বদলে বরং নিজের জেলার সম্ভাব্য উন্নয়ন নিয়ে বেশি ভাবিত।
অনেক বছর আগে একবার কুমিল্লা থেকে ঢাকা ফিরছি। তিশা পরিবহনের পাশের সিটে যিনি বসেছেন তিনি বারবার করে আমার দিকে তাকাচ্ছেন, কিছু বলতে চান যেন। অনেকক্ষণ উসখুস করার পর বললেন, ‘আপনি কি ঢাকায় থাকেন?’

‘জি। আপনি?’
‘আমিও ঢাকায় থাকি। আপনি ঢাকা কোথায় থাকেন?’
‘বাংলামোটর।’

‘আমার বাসাও বাংলামোটর। আপনি বাংলামোটর কোথায়?’
‘বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের গলি।’

‘আশ্চর্য। আমিও বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের গলি। কত নাম্বার বাসা?’
বাসার নাম্বার বললাম। তিনি আরো আশ্চর্য হয়ে বললেন, ‘আমার বাসার নাম্বারও তো ওটা।’

এবং এক সময় দেখা গেল আমরা দুজন একই বিল্ডিংয়ের ওপর-নিচে থাকি। মুখচেনা লাগছিল বলে ভদ্রলোক কৌতূহলী হয়ে কথা বলছিলেন। আমরা ঠিক এ রকম। ওপরের লোককে চিনি না, নিচের লোককে জানি না, চিনি শুধু নিজেকে। তাই কোনো সামাজিকতা তৈরি হয় না।

সামাজিক এবং সম্মিলিত স্রোত থাকলে সেই স্রোত আর শক্তিই মিলিতভাবে শহরকে ভালোবাসে। গড়ে তোলে। পাওনার জন্য চাপ তৈরি করে। ঢাকার দুর্ভাগ্য, তাকে ভালোবাসার এই সম্মিলিত স্রোতটাই নেই। কেন নেই, নগর বিশেষজ্ঞরা গবেষণা করে বের করতে পারবেন, এই তুচ্ছ লেখকের সেই সামর্থ্য নেই।

আমি শুধু জানি, গভীর রাতে বাড়ি ফেরার সময় আধো-অন্ধকারে অদ্ভুত ভালো লাগে রাতের ঢাকাকে। পৃথিবীর বহু বড় শহর দেখেছি সন্ধ্যার পর ঘুমিয়ে পড়ে। রাতের আমোদের কিছু জায়গা বাদ দিলে বাকিটা যেন ভূতের বাড়ি। আমাদের ঢাকা কী জীবন্ত আর চলন্ত। যত রাতেই বের হন, দেখবেন কিছু গাড়ি চলছে, কিছু মানুষ ছুটছে, কিছু জায়গা জেগে আছে। দেখতে দেখতে মনে হয়, সবাইকে নিয়ে, সব কিছু নিয়েও ঢাকা কত একা। সবটা ঐশ্বর্য বিলিয়ে দিয়ে সে পুরোপুরি নিঃস্ব। এই শহরটাকে সবাই ভোগ করে, কেউ ভালোবাসে না। তার ভাঙা রাস্তা, বিবর্ণ ছবি, নোংরা নর্দমা- এগুলো আসলে আমাদের নিষ্ঠুরতারই নৃশংস ছবি।

বড় দুঃখী আমাদের এই শহরটা! -[কালের কণ্ঠ ০৬ সেপ্টেম্বর ২০১৪]

@PNSNews24.com

আপনার মন্তব্য প্রকাশ করুন