সংকট নেই তবুও যেভাবে বাড়ে আলুর দাম

  20-04-2024 11:55AM



পিএনএস ডেস্ক: আবার অস্থির হয়ে উঠেছে আলুর বাজার। কেজিতে ১৫-২০ টাকা বেড়ে দাম হাফসেঞ্চুরি পার করেছে। এর নেপথ্যে রয়েছে সিন্ডিকেট। এ সিন্ডিকেট শুরু হয় আলু জমিতে থাকতেই। হিমাগারের নিয়োগ করা এজেন্টরা ভরা মৌসুমে জমি থেকেই কেনেন প্রান্তিক কৃষকের আলু। এরপর হিমাগারে রাখা, বাজারজাত করা, কী দামে কেনা হবে, কী দামে বিক্রি হবে- সবই নিয়ন্ত্রণ করেন এজেন্টরা। মধ্যস্বত্বভোগী, মজুদদার, আড়তদার ও হিমাগার মালিক এবং এজেন্টদের কারণেই মূলত আলুর বাজার টালমাটাল।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রান্তিক কৃষকের আলু হিমাগার মালিক ও এজেন্টদের হাতে তুলে দেন বড় চাষিরা। হিমাগার মালিকদের যোগসাজশে আলু হিমায়িত হয়। তারা হাজার হাজার বস্তা আলু মজুদ করে রাখেন। এরপর হিমাগার থেকে আলু মধ্যস্বত্বভোগী বা ফড়িয়ার মাধ্যমে যায় মোকামে। মোকাম থেকে উঠে আড়তে। সেখান থেকে কেনেন পাইকারি বিক্রেতা।

সর্বশেষ সেখান থেকে যায় খুচরা পর্যায়ে বিক্রির জন্য। এভাবে ছয় হাত ঘোরার পর ক্রেতার হাতে আসে আলু। ফলে বাড়তি দামে বিক্রির জন্য তদারকিও করেন মধ্যস্বত্বভোগী, মজুদদার, আড়তদার ও হিমাগার মালিক। তারা কৃত্রিম সংকট কিংবা দাম বৃদ্ধির অজুহাতে হাতিয়ে নেন বিপুল পরিমাণ অর্থ। সরকারের বিভিন্ন মহল এ সিন্ডিকেট ভাঙার উদ্যোগ নিলেও তাতে সফল হয়নি। বারবার অভিযান চালিয়েও ভাঙতে পারেনি সিন্ডিকেট; উল্টো বন্ধ রাখতে হয়েছে অভিযান।

রাজশাহীর তানোর উপজেলার আলু চাষি রেজাউল করিম চলতি মৌসুমে সাড়ে ১১ একর জমিতে আলু চাষ করেছিলেন। শ্রমিক ও সার-কীটনাশক বাবদ দোকানে বাকি হওয়ায় অধিকাংশ আলু জমি থেকেই বিক্রি করে দেন। বাকি আলু রাখেন কোল্ডস্টোরেজে। রেজাউল করিম প্রতিদিনের সংবাদকে বলেন, আমার মতো প্রান্তিক চাষিদের দিন শেষ। বৃহৎ সিন্ডিকেটের হাতে আলুর বাজার। এখন বড় বড় বিনিয়োগকারী মাঠে নেমেছেন। কৃষিতে বিনিয়োগ করছেন।

আলু মজুদ করে বাজারে কৃত্রিম সংকট তৈরি করছেন। দাম ওঠানামার ইশারা তাদের মধ্যেই হয়। আমরা জমি থেকে যা লাভ পাই, তাতে আমাদের বেশি কিছু হাতে থাকে না। ফলে প্রান্তিক চাষি হারিয়ে গেছে। বাণিজ্যিক চাষি আর ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট দাম বাড়ানোর জন্য দায়ী।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর বলছে, দেশে বর্তমানে বছরে আলুর চাহিদা ৯০ লাখ টন। সবচেয়ে বেশি আলু উৎপাদন হয় মুন্সীগঞ্জ, রংপুর, বগুড়া, জয়পুরহাটে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে আবাদ লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল ৪ লাখ ৬২ হাজার হেক্টর জমিতে। এতে উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয় ১ কোটি ১৬ লাখ ২২ হাজার টন। তবে মৌসুম শেষে ৪ লাখ ৫৮ হাজার ৫৬০ হেক্টর জমি থেকে ১ কোটি ৯ লাখ ৫৪ হাজার ৫০২ টন আলু উৎপাদন হয়। হেক্টরে ফলন হয় ২৩.৯০ টন। এর মধ্যে উচ্চফলনশীল আলু আবাদ করা হয় ৩ লাখ ৯৩ হাজার হেক্টর জমিতে। আর স্থানীয় আলু আবাদ করা হয় ৫৬ হাজার ৫০৫ হেক্টর জমিতে।

জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) হিসাবে, দেশে উৎপাদিত আলুর প্রায় ২৫ শতাংশ বিভিন্ন কারণে নষ্ট হয়ে যায়। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হিসাবে, গত অর্থবছরে দেশে আলুর উৎপাদন হয়েছে ১ কোটি ৪ লাখ ৩১ হাজার টন। এর আগে ২০২১-২২ অর্থবছরে ১ কোটি ১ লাখ ৪৪ হাজার ৮৩৫ টন এবং ২০২০-২১ অর্থবছরে ৯৮ লাখ ৮৭ হাজার ২৪২ টন আলু উৎপাদন হয়। সংশ্লিষ্টদের হিসাব অনুযায়ী, উৎপাদন মৌসুমণ্ডপরবর্তী পচন ও বিনষ্টের কারণে প্রতি বছর দেশে প্রায় ২৬-২৭ লাখ টন আলু নষ্ট হয়ে যায়।

এরপরও দেশে আলুর উৎপাদনের তুলনায় চাহিদা পূরণ সম্ভব। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কারওয়ানবাজারের এক পাইকারি আলু ব্যবসায়ী প্রতিদিনের সংবাদকে বলেন, ‘আলুর ভরা মৌসুমে এত দাম সিন্ডিকেটের কারণে। বাজারে আলুর দাম নিয়ন্ত্রণ করেন তারাই। মোকামে আলু নিতে গেলে বলেন দাম বেশি। কৃষকের ঘরেও খুব বেশি আলু নেই। তারা দাম পান না। দাম বেশি করে সাপ্লাই চেইনে থাকা স্টোরেজ আর বড় বড় ব্যবসায়ী। আমরা পাইকারিতে বিক্রি করছি ৪২ টাকা কেজি। খুচরায় কোথাও কোথাও ৬০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।’

কারওয়ানবাজারের পাইকারি আলু বিক্রিয় প্রতিষ্ঠান মক্কা ট্রেডার্সের কর্মচারী সোহেল রানা বলেন, ‘বেপারিরা দাম বাড়ায়ে দিছে। আমাদের কিছু করার নাই। কৃষকের ২৫ টাকা কেজির আলু ঢাকায় ৫৫ থেকে ৬০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। ৮০ টাকা কেজি বিক্রি হতে পারে আলু। বাজারে অভিযান হয় কিন্তু হিমাগার কিংবা মোকামে অভিযান হয় না। হাজার টাকা মণ আলু কিনে ২ হাজার টাকা মণ বিক্রির সঙ্গে কারা আছে মোকামে গেলেই জানতে পারবেন।’

বাংলাদেশ কোল্ডস্টোরেজ অ্যাসোসিয়েশন বা হিমাগার সমিতি সম্প্রতি এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছিল, এবার বছরব্যাপী প্রতি কেজি আলু ৫০ টাকার ওপরে কিনতে হবে। অথচ এ ভবিষ্যদ্বাণী করার পর মৌসুম শেষ হতে না হতেই পঞ্চাশে ঠেকে আলুর দাম। টিসিবির তথ্যমতে, গত বছরের এ সময় বাজারে আলুর কেজিপ্রতি দাম ছিল ২৪ থেকে ৩০ টাকা, অর্থাৎ এ বছর আলু প্রায় দ্বিগুণ দামে কিনতে হচ্ছে ভোক্তাদের। আলুর বর্তমান দাম গত বছরের তুলনায় ৫৭ শতাংশ বেশি।

বাংলাদেশ কোল্ডস্টোরেজ অ্যাসোসিয়েশনের তথ্য বলছে, ২০২২-২৩ অর্থবছরে সারা দেশের কোল্ডস্টোরেজে ২২ লাখ টন আলু মজুদ ছিল। এবার আরো ২ লাখ টন আলু বেশি মজুদ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। ফলে ২৫ লাখ টনের বেশি হতে পারে এবার। তবে বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন (বিএডিসি) সূত্র বলছে, এখনো অনেক কোল্ডস্টোরেজ ফাঁকা আছে। এবার আলুর দাম ৮০ টাকার ওপরে উঠে যাওয়ার ভয়ে আমদানির অনুমতি দেওয়া আছে- যাতে দাম নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়। সাধারণত মে-জুন-জুলাই মাসে আলু কোল্ডস্টোরেজ থেকে বের হয়। কিন্তু এবার যদি মে মাসে কোল্ডস্টোরেজ খুলে দেওয়া হয়, তাহলে ভয়ংকর পরিস্থিতি দাঁড়াতে পারে। এজন্য সরকার আমদানি করে আলুর দাম নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা করছে।

বাংলাদেশ কোল্ডস্টোরেজ অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মোস্তফা আজাদ চৌধুরী বলেন, এবার কৃষকের কাছ থেকেই বেশি দামে আলু বাজারে এসেছে। কৃষকরা জমি থেকে ২৫ টাকা থেকে আলু বিক্রি শুরু করেন। এখন ৪০ টাকা দরে বিক্রি করছেন। হিমাগারে রাখা আলুর দামও বেশি পড়েছে। এছাড়া গত বছর আলুর যে সংকট হয়েছিল, তা কাটিয়ে ওঠার জন্য বাড়তি যে উৎপাদন দরকার ছিল, সেটা হয়নি। এবার আলুর উৎপাদন কম হয়েছে। সব মিলিয়ে এবার আলুর দাম বেশি থাকবে। এখানে কোনো সিন্ডিকেট নেই। বাজারে আলুর সংকট আছে কি না, তাও বলতে পারব না। সরকার আমদানির অনুমতিও দিয়ে রেখেছেন।

আজাদ চৌধুরী আরো বলেন, ‘১ কেজি আলু ১৩ টাকা ৫০ পয়সায় উৎপাদন করে ৪০ টাকায় কেন বিক্রি করছে সেটা কৃষককে জিজ্ঞাসা করুন। আমরা এসব বিষয়ে জানি না। স্টোরেজ এখনো ফাঁকা আছে। আগামী মে মাসের প্রথম সপ্তাহে বলতে পারব কী পরিমাণ আলু স্টোরেজ হয়েছে। এখন কৃষকের আলু বাজারে বিক্রি হচ্ছে। স্টোরেজের আলু পরে বের হবে।’

কৃষি মন্ত্রণালয়ের তথ্য বলছে, প্রায় ২৫-২৬ লাখ টন আলু অতিরিক্ত হিসেবে থেকে যায় বিধায় অনেক সময় বাজারমূল্য কমে যাওয়ার ফলে কৃষকরা ক্ষতিগ্রস্ত হন। সেটি নিয়ে ২০২২ সালের মে মাসে কৃষি মন্ত্রণালয় একটি রোডম্যাপও করেছিলেন। সব শেষে চাহিদার তুলনায় উৎপাদন বেশি হলেও কয়েক বছর আলুর দামে প্রভাব পড়েনি, অন্যদিকে রপ্তানিও কমতে থাকে। ফলে চড়া দামে বিক্রি হয় আলু।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত পরিচালক (সরেজমিন উইং) মো. ছাইফুল আলম বলেন, ‘কৃষকরা আলুর ভালো দাম পাচ্ছেন। চাষিরা লাভবান হোক এটাই সবার চাওয়া। আলুর দাম বৃদ্ধির পেছনে কোনো সিন্ডিকেট আছে বলে মনে হয় না।’ তবে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বাদল চন্দ্র বিশ্বাস বলেন, ‘কৃষকের কাছ থেকে কম দামে আলু কেনেন ব্যবসায়ী, মজুদদার, আড়তদার ও হিমাগার মালিক। কিন্তু তারা বেশি দামে বিক্রি করেন। ফলে দামও বেশি হয়। বাজার ঠিক রাখতে হলে কৃষকের দিকে তাকাতে হবে।’


পিএনএস/এমএইউ

@PNSNews24.com

আপনার মন্তব্য প্রকাশ করুন