‘আমি তো কাউকে বাসায় আসার জন্য জোরাজুরি করিনি’

  12-02-2024 02:16PM



পিএনএস ডেস্ক: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের ১২তম ব্যাচের শিক্ষার্থীদের ফলাফলে ধস নামিয়ে দিয়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে ওই বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক ড. নাদির জুনাইদের বিরুদ্ধে। গত ৭ ফেব্রুয়ারি ওই ব্যাচের শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন। এর দু’দিন পর একই বিভাগের এক নারী শিক্ষার্থী অধ্যাপক নাদির জুনাইদের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানি ও মানসিক নিপীড়নের অভিযোগ তুলেছেন।

বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর বরাবর লিখিত অভিযোগে ওই শিক্ষার্থী জানিয়েছেন, শিক্ষক নাদির জুনাইদ তাকে প্রায়ই অরুচিকর কথাবার্তা বলতেন। রাতে কল করে নানা যৌন ইঙ্গিতপূর্ণ কথাও বলতেন। শারীরিক সম্পর্ক স্থাপনের জন্য প্রস্তাবও দিতেন। 'দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমি দেড় বছরেরও বেশি সময় ধরে যৌন হয়রানির শিকার হয়েছি। এটিকে আমি কেবল ব্যক্তিগত আগ্রাসন হিসেবে বর্ণনা করতে পারি।' এসব অভিযোগের বিষয়ে একটি দৈনিকের মুখোমুখি হয়েছেন প্রায় দুই যুগ ধরে শিক্ষকতা করে আসা অধ্যাপক ড. নাদির জুনাইদ। একান্ত সাক্ষাৎকারে এসব অভিযোগকে তিনি ভিত্তিহীন ও মিথ্যা দাবি করেছেন।

শিক্ষার্থীদের ফলাফলে ধস নামিয়ে দেওয়ার অভিযোগের ব্যাপারে অধ্যাপক জুনাইদ বলেন, গত ছয় ফেব্রুয়ারি আমাদের বিভাগের মাস্টার্স পরীক্ষার ফল প্রকাশিত হয়। সেই ফল প্রকাশের কিছুক্ষণ পরই বিভিন্ন সংবাদপত্রে রিপোর্ট প্রকাশিত হতে শুরু হয় যে, আমার জন্য নাকি ওই ব্যাচের ফলে ধস নেমে গেছে। ওই ব্যাচের মৌখিক পরীক্ষার বোর্ডে চারজন এক্সামিনার (পরীক্ষক) ছিলেন।

আমি তাদের মধ্যে একজন এবং চারজনই নম্বর দিয়েছেন। সেই নম্বর গড় করে চূড়ান্ত নম্বর করা হয়েছে ৷ কাজেই এককভাবে কিন্তু আমার কোনো নম্বর দেওয়ার সুযোগ ছিল না। এরপর রিটেন পরীক্ষার খাতাও আমি একা দেখিনি। এটা সেকেন্ড এক্সামিনারের কাছে গিয়েছে। থার্ড এক্সামিনারের কাছেও হয়তো গিয়েছে। ফলে, আমাদের ওভাবেই গড় করেই নম্বর দেওয়া হয়েছে।

সেখানেও এককভাবে আমার নম্বর দেওয়ার সুযোগ নেই। এভাবে যখন আমি দেখলাম যে, আমার এককভাবে কোনো নম্বর যায়নি, তারপরও অন্য আর কাউকে দায়ী না করে, পুরো কমিটিকে কিছু না বলে শুধু বলা হচ্ছে, নাদির জুনাইদের কারণে রেজাল্টে ধস নেমেছে। এটা বলা তো সম্পূর্ণ অযৌক্তিক।


ড. নাদির জুনাইদ বলেন, এটা যখন একের পর এক ছবি দিয়ে রিপোর্ট হচ্ছে তখনই আমার কানে খবর আসতে থাকল, বিভিন্ন জায়গা থেকে নাকি কিছু মানুষকে বলা হচ্ছে যে, আমার বিরুদ্ধে যেন আরও অভিযোগ দেয়। অনেককেই নাকি জোরাজুরি করা হচ্ছে অভিযোগ দেওয়ার জন্য। একদিকে আমার বিরুদ্ধে একটা অযৌক্তিক অভিযোগ করা হলো যে, নম্বর কম দিয়েছি। আবার অন্য আরও লোকজনকেও বলা হচ্ছে বিভিন্ন রকমের আরও অভিযোগ দেওয়ার জন্য।

এ জন্য গত ৯ ফেব্রুয়ারি রাতে আমি শাহবাগ থানায় জিডি করি যে, বিভিন্ন ব্যক্তি পীড়াপীড়ি করছে আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ দেওয়ার জন্য। এরপর ১০ ফেব্রুয়ারি দুপুর বেলা একটা অভিযোগ আসল, যেটা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে দেওয়া হয়েছে। যদিও বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আমাকে অফিসিয়ালি কিছু জানানো হয়নি। সেই অভিযোগে আমার বিরুদ্ধে একটি মানসিক নির্যাতন এবং যৌন হয়রানির কথা বলা হয়েছে। এর কিছুক্ষণের মধ্যেই দেখা গেল যে, একের পর এক মিডিয়ায় রিপোর্ট হচ্ছে এবং আমার ছবি দিয়ে পোস্ট করা হচ্ছে বিভিন্ন জায়গায়।

আমার কথা হলো যে, এ বিষয়ে অভিযোগ প্রমাণিত হয়নি। তদন্তসাপেক্ষ ব্যাপার ৷ তদন্তে প্রমাণিত হওয়ার পর যদি কেউ দোষী হয় তখন তার বিরুদ্ধে রিপোর্ট করা যেতে পারে ৷ কোনো একটি তদন্তে দোষী হওয়ার পরেও আপিল করার সুযোগ থাকে। এই যে একটি অভিযোগ হলো এটা সত্যি নয়, সম্পূর্ণভাবে মিথ্যা। এগুলো চুলচেরা বিশ্লেষণের মাধ্যমে তদন্ত কমিটি প্রমাণ করবে। তারপর সিদ্ধান্ত হবে কে দোষ করেছে। কিন্তু, এখানে অভিযোগ আসার কিছুক্ষণের মধ্যেই যেভাবে সংবাদ আসতে থাকল এবং ছবিসহ আমাকে দোষী বানিয়ে দেওয়া হলো।

আমি কোনো প্রমাণ উপস্থাপন করার আগেই আমাকে একের পর এক রিপোর্ট করে সামাজিকভাবে খুব খাটো করা হলো। কেউ তো জানতে চাইল না যে, আপনার বক্তব্যটি কী। আমাকে মিডিয়া ট্রায়ালের মধ্যে নিয়ে যাওয়া এই ব্যাপারটি গ্রহণযোগ্য নয়।

ওই শিক্ষার্থীর অভিযোগের প্রসঙ্গ টেনে ড. নাদির জুনাইদ বলেন, অভিযোগপত্রে ভেতরে আছে যে, আমার জন্মদিনে নাকি অভিযোগকারী বাসায় এসেছিলেন, তখন হয়রানি করেছি। কিন্তু আমি বলতে চাই, আমার বিভাগের একজন শিক্ষার্থী আমার গত জন্মদিনে বাসায় এসেছিলেন ফুল নিয়ে। ফুল উপহার দিয়েছেন ওইদিন। অথচ তিনি অভিযোগপত্রে উল্লেখ করেছেন যে, তার আগে থেকেই অর্থাৎ গত দেড় বছর ধরেই তিনি আমার দ্বারা বিভিন্নভাবে মানসিক অত্যাচারের বা নিপীড়নের শিকার হয়েছেন।

আমার কথা হলো, যিনি ২০২২ সাল থেকেই আমার দ্বারা বিভিন্ন প্রশ্নের সম্মুখীন হয়েছেন তাহলে ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে আমার বাসায় কেন আসবেন? আমি তো কাউকে আসার জন্য জোরাজুরি করিনি। তিনি আসছেন স্বেচ্ছায়। তিনি দুপুরের দিকে এসে বিকেল পর্যন্ত ছিলেন এবং বাসার ছাদেও গিয়েছেন। অভিযোগে তিনি বলেছেন, আমি ছাদে তাকে হয়রানি (হ্যারাজ) করেছি। এটা যদি করেই থাকি তাহলে ওই মুহূর্তে তো তার উচিত ছিল এই বাসা থেকে চলে যাওয়ার। কিন্তু তিনি তো বিকেল পর্যন্ত ছিলেন। তিনি আমাদের সাথে দুপুরে খেয়েছেন, চা খেয়েছেন বা পরিবারের অন্য সদস্যদের সাথে কথাও বলেছেন এবং এটাও বলেছেন যে, তিনি আবার আসবেন। ক্রিসমাসের দিন আবার আসবেন তিনি। আবার এসে রান্নাবান্না করবেন এই কথাও আমাকে তিনি বলে গিয়েছেন।

এটা তো অত্যন্ত সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্কের পরিচয় নির্দেশ করে যে, জন্মদিনে বাসায় আসছে, আবার বলেও যাচ্ছে যে, ক্রিসমাসের দিনও আবার আসবেন। তার সাথে আমার এই মাসের গত ৭ তারিখেও কথা হয়েছে। ৬ তারিখে আমার বিরুদ্ধে ফলাফলে ধস নামানোর যে রিপোর্টটি এসেছে সেই রিপোর্টটা সম্পর্কে তার সাথে কথা হয়। ওই শিক্ষার্থী এ বিষয়ে বলেন, এটা একেবারেই অন্যায় হচ্ছে আপনার বিরুদ্ধে। আমরা সবাই আপনার সাথে আছি। আপনি চিন্তা করবেন না। তিনি আমাকে এই কথাগুলো বললেন এবং ৯ তারিখ রাতেও তার সাথে কথা হয়েছে।

তিনি বলেন, এর আগে গত বছরের নভেম্বর মাসে তিনি একদিন রাতে আমাকে ফোন দিয়েছেন। আমি ফোন ধরতে পারিনি। পরের দিন আমি মেসেজ করে জিজ্ঞাসা করেছিলাম যে, সে কেন ফোন দিয়েছিল। তখন তিনি আমাকে বলেছিলেন কোনো দরকার ছিল না, এমনি ফোন দিয়েছিলাম। এখন কথা হলো যে, যদি তাকে বিগত দেড় বছর ধরে আমি হ্যারাস করেই থাকি, তাহলে নভেম্বর মাসে কল দিয়ে এমনি কল দিয়েছি বলার কথা নয়। আমি নভেম্বর মাসেই একটা টেলিভিশনের টকশোতে গিয়েছিলাম।

সেটার ভিডিও ক্লিপ দেখে তিনি বলেছিলেন যে, খুব ভালো লেগেছে। সবসময় তার সাথে ভালোভাবেই কথাবার্তা হয়েছে। ২০২৩ সালের ৮ সেপ্টেম্বর তার কাছ থেকে একটি মেসেজ এসেছিল। তিনি তাতে লিখেছিলেন যে, আশা করি আপনার শুভ এবং সুন্দর প্রভাব আমার ভিতর এবং বাহিরকে তথাকথিত বাহ্যিক সুন্দরের সংজ্ঞা ছাড়িয়ে সত্যি সৌন্দর্যমণ্ডিত করবে।

আমার কথা হলো যে, যদি আমি তাকে দেড় বছর ধরে হ্যারাস করে থাকি তাহলে গত সেপ্টেম্বরে তিনি আমাকে এই কথা কী করে লেখেন? আমি খুব বিস্মিত হয়েছি যে, যার সাথে আমার এ রকম এক ধরনের যোগাযোগ ও সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক আছে, তার কাছ থেকেই এই ধরনের অভিযোগগুলো আসছে। এটা কেন এই সময় আসল? এ সময় হঠাৎ করে ১টা মিথ্যা অভিযোগ আমার বিরুদ্ধে আসার পরপরই এই অভিযোগটি আসল এমন একজনের কাছ থেকে যার সাথে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক আছে।

অধ্যাপক নাদির জুনাইদ বলেন, আমি একজন বিচারপতির সঙ্গে কথা বলেছি। তিনি বলেছেন যে, যদি আপনি কখনো কাউকে ইঙ্গিতপূর্ণ কথা বলে থাকেন, ইঙ্গিতপূর্ণ কথা বললে যদি তিনি হ্যারাসমেন্ট অনুভব করেন তার উচিত তখনই যোগাযোগ বন্ধ করা। আপনি হ্যারাসমেন্টের কথা বলার পরও যদি আপনার সাথে যোগাযোগ কন্টিনিউ করতে থাকেন, তাহলে বুঝবেন যে, তিনি মনে করছেন, হ্যারাসমেন্ট হয়নি।

আমার কথা হচ্ছে, তিনি কিন্তু আমার সাথে নর্মালি যোগাযোগ রেখেছেন। তাহলে হ্যারাসমেন্ট করলে বা মানসিক টর্চার করে থাকলে তখনই তো আমার সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ করে দেওয়ার কথা। এখন না করে আরও আগে অভিযোগটা করতে পারতেন বিভাগের চেয়ারম্যানের কাছে বা বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে। কিন্তু, তিনি তা করেননি। আমি চাই, এই অভিযোগের সুষ্ঠু তদন্ত হোক। এতে আমিও কথা বলব, যিনি অভিযোগ করেছেন তিনিও কথা বলবেন। ঘটনায় যিনি দোষী তিনিই শাস্তি পাবেন। তদন্তকারীরা সুষ্ঠুভাবে বিশ্লেষণ করে সবকিছু দেখবেন। তারপর সিদ্ধান্ত আসবে। কিন্তু, তদন্ত হওয়ার আগেই, দোষী সাব্যস্ত হওয়ার আগেই, আমার ছবি দিয়ে যে আমাকে দোষী বানিয়ে দেওয়া হচ্ছে, সেটা খুবই দুঃখজনক।

নারী শিক্ষার্থীর অভিযোগপত্রে উল্লেখ করা বিভিন্ন মেসেজ বা কথোপকথনের ব্যাপারে জিজ্ঞেস করলে অধ্যাপক নাদির জুনাইদ বলেন, এগুলো তদন্ত কমিটির সামনে আমি বলব। এখন মন্তব্য করা সম্ভব নয়। ওই শিক্ষার্থীর অভিযোগপত্রে সিসি ক্যামেরার মাধ্যমে নজরদারির যে অভিযোগের কথা বলা হয়েছে সে প্রসঙ্গে এই অধ্যাপক বলেন, আমার বিভাগীয় কক্ষে সিসি ক্যামেরা পাব কোথায়? সিসি ক্যামেরা মনিটর চেয়ারম্যানের রুমে রাখা। আমি তো আর চেয়ারম্যানের রুমে বসে থাকি না।

চেয়ারম্যানের কক্ষে আমরা যখন যাই তখন আমরা সবাই মনিটর দেখি। এখানে আলাদা করে নজরদারির কোনো বিষয় আসে না তো। চেয়ারম্যানের কক্ষে গিয়ে যে কেউ সিসি ক্যামেরার স্ক্রিন দেখতে পায়। এই দেখার মানে এই না যে, কাউকে নজরদারি করা। আমার কারও সাথে কোনো অনৈতিক সম্পর্ক যদি থাকত তাহলে আমি তাকে অনৈতিকভাবে মার্কস (নম্বর) দিতাম। কিন্তু, ডিপার্টমেন্টের কেউ কখনো বলতে পারবেন না যে, কারও সাথে সম্পর্কের কারণে আমি তাকে মার্কস বেশি দিয়েছি। আমি মার্কিংয়ের বিষয়ে অনেক স্ট্রিক্ট। যদি কেউ খাতায় লেখে তাহলে মার্কস পায়, আর না লিখলে সে পায় না।

আমি কাউকে খুশি করার জন্য নম্বর দেই না। এমনকি যিনি জন্মদিনে আমার বাসায় এসেছেন এবং আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছেন তিনিও আমার কোর্সে ভালো লিখলে ভালো নম্বর পেয়েছেন। ভালো না লিখলে পাননি। ক্লাসেও কেউ যদি ভালো করে তাহলে তার প্রশংসা করি। অর্থাৎ যাদের আমি পছন্দ করি তাদের ভালো নম্বর দেই এমনটা কখনো হয়নি। যারা আমার সাথে যোগাযোগ রাখে এমনও আছে তারাও অনেক কম নম্বর পেয়েছে, যেহেতু তারা ভালো লেখেনি।

ফলাফলে ধস নামানোর অভিযোগের দু’দিন পরেই কেন এমন অভিযোগ আসল এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, আমার বিরুদ্ধে দুরভিসন্ধি হচ্ছে, ষড়যন্ত্র হচ্ছে। আগামী জুনে আমার বিভাগের চেয়ারম্যান হওয়ার কথা। বিশেষ উদ্দেশে টার্গেট করে আমার বিরুদ্ধে এখন নানা অভিযোগ তোলা হচ্ছে।


পিএনএস/এমএইউ

@PNSNews24.com

আপনার মন্তব্য প্রকাশ করুন