পারভেজ মোশাররফের ঘটনাবহুল জীবন

  05-02-2023 03:44PM



পিএনএস ডেস্ক: দীর্ঘদিন অসুস্থ থাকার পর পাকিস্তানের সাবেক প্রেসিডেন্ট ও সেনাপ্রধান জেনারেল পারভেজ মোশাররফ মারা গেছেন। ৭৯ বছর বয়সী এই সাবেক প্রেসিডেন্ট সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাইয়ের একটি হাসপাতালে রবিবার মারা যান। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৭৯ বছর।

দীর্ঘ নয় বছর ধরে (১৯৯৯-২০০৮) পাকিস্তানের সেনাপ্রধান ছিলেন পারভেজ মোশাররফ। এছাড়া তিনি দেশটির ১০তম প্রেসিডেন্ট ছিলেন। ২০০১ সাল থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত তিনি প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পালন করেন।

ভারত-পাকিস্তান ভাগ হওয়ার আগে ১৯৪৩ সালের ১১ আগস্ট দিল্লিতে জন্মগ্রহণ করেন পারভেজ মোশাররফ। পরবর্তীতে দুই দেশ ভাগ হলে তার পরিবার করাচি হলে যায়। সেখানেই তিনি পড়ালেখা শুরু করেন। ১৯৬৪ সালে পাকিস্তানের মিলিটারি একাডেমি থেকে স্নাতক সম্পন্ন করার পর তিনি সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। পরবর্তীতে তিনি পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে কমিশন লাভ করেন।

পাক সেনাবাহিনীতে থাককালীন তিনি সর্বপ্রথম ১৯৬৫ সালে যুদ্ধের মুখোমুখি হন। সে সময়ে ভারতের সঙ্গে পাকিস্তান যুদ্ধে লিপ্ত হয়। এরপর তিনি ১৯৬৬ থেকে ১৯৭২ সাল পর্যন্ত স্পেশাল সার্ভিসেস গ্রুপ (এসএসজি) এর দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭১ সালের পর, তিনি বেশ কয়েকটি সামরিক কাজে দক্ষতা অর্জন করতে থাকেন এবং সেনাবাহিনীতে দ্রুত পদোন্নতি লাভ করেন।

১৯৯৮ সালে পাকিস্তানের সেনা প্রধান হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন মোশাররফ। ওই সময়ে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নেওয়াজ শরীফ তাকে সেনা প্রদানের দায়িত্বে নিযুক্ত করেন। পরের বছরই সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ভয়াবহ হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট পদে আসিন হন পারভেজ মোশাররফ।

১৯৯০ সালের ১২ অক্টোবর শ্রীলঙ্কা থেকে ফেরার পথে তাকে করাচি বিমানবন্দরে নামতে বাধা দেয় প্রধানমন্ত্রী। পরে তার আদেশে দেশটির সেনাবাহিনী প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন দখল করে নেয়।

পরবর্তীতে তিনি সংবিধান অমান্য করে জরুরি পরিস্থিতি ঘোষণা করেন। এবং প্রধান নির্বাহী হিসেবে নিজেকে অধিষ্ঠিত করেন। এ নিয়ে পাকিস্তানের অভ্যন্তরে কোনো আন্দোলন না হলেও, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় পারভেজ মোশাররফের ব্যাপক সমালোচনা করে। ২০০১ সালের জুনে তিনি পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট হন।

প্রেসিডেন্টের ক্ষমতা ভার গ্রহণ করার কিছুদিন পরই ৯/১১ হামলা হয়। এরপরই ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’ ঘোষণা করে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে জোট গঠন করে। যেটি পাকিস্তানের অন্যান্য সামরিক বাহিনীর কর্মকর্তারা রক্ষা করেন।

জেনারেল পারভেজ ক্ষমতায় আসার কয়েক বছরের মধ্যেই ইসলামপন্থী জঙ্গীদের হামলার দ্বারা হত্যাচেষ্টার শিকার হয়েছিলেন যদিও প্রত্যেকবারই তিনি বেঁচে যান তিনি। ২০০২ সালে তিনি দেশের সংবিধানে পরিবর্তন আনেন। তিনি সামাজিক উদারনীতিবাদ এর একজন গোঁড়া সমর্থক ছিলেন এবং তিনি পাকিস্তানের জন্য 'এনলাইটেন্ড মোডারেশোন প্রোগ্রাম' চালু করেন, সঙ্গে সঙ্গে তিনি 'ইকোনমিক লিবারেলাইজেশোন' শক্তভাবে চালু করে ট্রেড ইউনিয়ন নিষিদ্ধ করেছিলেন।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তথাকথিত "সন্ত্রাস বিরুদ্ধে যুদ্ধ" নামেও আফগানিস্তানে যে হামলা শুরু করে তার পুরোভাগে ছিলেন পারভেজ। যুক্তরাষ্ট্রে হামলার দায়ে ২০০১ সালে ১/১১ হামলার পর আফগানিস্তান আক্রমণ করে মার্কিন বাহিনী। মোশাররফ বলেছিলেন, তৎকালীন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী কলিন পাওয়েল ফোনে তাকে আলটিমেটাম দিয়েছেন যে: "আপনি আমাদের সাথে আছেন অথবা আমাদের বিপক্ষে।"

মোশাররফ আফগান তালেবানদের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে আমেরিকা ও ন্যাটো পাকিস্তানের ভূমি ব্যবহার আফগানিস্তানে হামলার অনুমতি দেন ও পাকিস্তানের কয়েকটি অঞ্চলে মার্কিন ড্রোন হামলার অনুমোদন দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রকে সাহায্য করেন।

২০০৭ সালে তিনি সামরিক বাহিনীকে রাজধানী ইসলামাবাদের একটি মসজিদে হামলা চালানোর নির্দেশ দিয়েছিলেন। একজন মুসলিম নেতা তার নির্দেশনা অমান্য করে স্থানীয় ব্যবসায়ীদের উপর হামলার আদেশ দিয়েছিলেন। এসময় শতাধিক লোক নিহত হয়েছিল।

মোশাররফ ২০০৭ সালের নভেম্বরের আগে বিতর্কিতভাবে সেনাপ্রধানের পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন, এ মাসেই তার শাসনের বিরুদ্ধে ব্যাপক গণজোয়ার শুরু হলে পাকিস্তানে জরুরি অবস্থা জারি করেছিলেন। ৩ নভেম্বর সেনাশাসক জরুরি অবস্থা জারি করে সংবিধান স্থগিত করেন এবং গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক নেতা ও বিচারকদের আটকে রাখেন।

মূলত, ২০০৭ সালের মার্চে পাকিস্তান সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি ইফতেখার মাহমুদ চৌধুরীকে অবৈধভাবে অবসরে পাঠায় মোশাররফ। এরই প্রেক্ষিতে আইনজীবীরা আন্দোলন শুরু করলে রাজনৈতিক ও অন্যান্য গোষ্ঠীরাও যোগ দেয়।

অস্থির অর্থনীতি এবং পণ্যের মূল্য বৃদ্ধির কারণে আন্দোলন ত্বরান্বিত হয়। সেনাবাহিনী প্রধান ও রাষ্ট্রপতির একই সাথে দুই পদ দখল করে রাখার জন্য চাপের মুখোমুখি হয়ে মোশাররফ তার উত্তরসূরি হিসাবে গোয়েন্দা প্রধান জেনারেল আশফাক পারভেজ কায়ানিকে নিয়োগ দিয়ে সেনাপ্রধান থেকে পদত্যাগ করে বেসামরিক প্রেসিডেন্ট হন।

প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে তিনি ডিসেম্বরের মাঝামাঝিতে জরুরি অবস্থা বাতিল করেন। পরবর্তীতে গণআন্দোলনের মুখে ২০০৮ সালের আগস্ট মাসে নির্বাচিত সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করে স্বেচ্ছা নির্বাসনে চলে যান তিনি।

নাওয়াজ শরিফ রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগ এনে মামলা করেন মোশাররফের বিরুদ্ধে। এরই মধ্যে পদত্যাগ করেন মোশাররফ। ২০০৯ সালে পাকিস্তানের সুপ্রিম কোর্ট জানায় দেশে জরুরি আবস্থা জারি ছিল অসাংবিধানিক। কেন রাষ্ট্রপতি হিসাবে জরুরি অবস্থা জারির পদক্ষেপ করেছিলেন পারভেজ মোশাররফ? আত্মপক্ষ সমর্থনের জন্য সুপ্রিম কোর্ট মোশাররফকে তলব করলে দেশ ছাড়েন তিনি।

২০১০ সালে তিনি অল পাকিস্তান মুসলিম লীগ (এপিএমএল) নামে একটি নতুন রাজনৈতিক দল প্রতিষ্ঠা করেন। তবে দলটি পাকিস্তানি ভোটারদের আস্থা অর্জন করতে ব্যর্থ হয়েছিল। এপিএমএল ২০১৩ সালে সংসদে একটি নির্জন আসন লাভ করেছিল এবং ২০১৮ সালের নির্বাচনে কোনো আসনই পায়নি।

২০১৩ সালের নির্বাচনে মোশাররফের প্রতিদ্বন্দ্বী নওয়াজ শরীফ প্রধানমন্ত্রী হয়ে পুনরায় ক্ষমতায় ফিরে আসেন। নওয়াজ শরিফের নেতৃত্বাধীন পাকিস্তান মুসলিম লিগের (এন) আমলে তার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলার বিচার শুরু হয়েছিল।

অবশ্য ২০১৬ সালের মার্চ মাসে আদালতের অনুমতি নিয়েই তিনি চিকিৎসার উদ্দেশ্যে পাকিস্তান ত্যাগ করে দুবাই চলে যান। তারপর থেকে আর দেশে ফেরেননি পাকিস্তানের প্রাক্তন এই সামরিক শাসক।

পিএনএস/আনোয়ার

@PNSNews24.com

আপনার মন্তব্য প্রকাশ করুন