সৃষ্টির সেবা ও মানব কল্যাণ

  13-02-2023 09:10AM

পিএনএস ডেস্ক: সৃষ্টির সেবা ইসলামের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। বস্তুত ইলম বিতরণ ও বক্তৃতার দ্বারা মানুষের মস্তিষ্ককে বশীভূত করা যায়। আল্লাহর পরিচয় ও প্রিয় নবীর জীবনী, জান্নাত জাহান্নাম তথা আখেরাতের বর্ণনা, নবী-রসুলগণ, সাহাবা আজমাইন, ওলি আবদাল, বুজুর্গানে দীনদের ঘটনা এবং তাদের কাশফ ও কারামত ইত্যাদি বিবরণের মাধ্যমে মানুষের ইমানি শক্তি বৃদ্ধি পায়, আমলের প্রতি জজবা সৃষ্টি হয়; কিন্তু মানুষের অন্তরকে তেমন কোনো প্রভাবিত করা যায় না। মানুষের অন্তর প্রভাবিত হয় সেবা ও খেদমতের দ্বারা। মানুষের বিপদ-আপদে পাশে দাঁড়ানো, তাদের সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেওয়া, যে কোনো প্রকারের পেরেশানি ও কষ্ট থেকে মানুষকে উদ্ধার করা, অনাহারি দুস্থদের মধ্যে খাদ্য বিতরণ করা। অসুস্থ, আহত, রোগাগ্রস্ত ব্যক্তিদের চিকিৎসাসেবার মাধ্যমে সুস্থ করে তোলা। বন্যা, মহামারি ও অগ্নিকান্ডে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের পুনর্বাসন করা। সর্বোপরি নির্যাতিত মজলুম ক্ষতিগ্রস্ত লাঞ্ছিত-বঞ্চিত ব্যক্তিদের পাশে দাঁড়িয়ে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেওয়া ইত্যাদি। এ সেবা বা খেদমত দুভাবে করা যায়- ১. আত্মিক, ২. বৈষয়িক। বৈষয়িক সেবার তুলনায় আত্মিক সেবার বিষয়টি অধিক গুরুত্বপূর্ণ। এ কারণে কোরআন ও হাদিসে আত্মিক সেবার প্রতি বিশেষ গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম খাইবার যুদ্ধের প্রাক্কালে হজরত আলী (রা.)-কে লক্ষ্য করে বলেছিলেন : আল্লাহর কসম তোমার দাওয়াতে আল্লাহতায়ালা যদি মাত্র একজন মানুষকেও হেদায়েত দান করেন তবে তা তোমার জন্য লাল বর্ণের মূল্যবান উটের মালিক হওয়া অপেক্ষাও অনেক উত্তম। (বোখারি)। বৈষয়িক খেদমতের প্রতি গুরুত্বারোপ করে কোরআন মাজিদে ইরশাদ হয়েছে : পূর্ব এবং পশ্চিম দিকে তোমাদের মুখ ফেরানোর মধ্যে কোনো পুণ্য নেই, কিন্তু পুণ্য রয়েছে আল্লাহ, পরকাল, ফেরেশতাগণ, কিতাবসমূহ এবং নবীগণের ওপর ইমান আনয়ন করার মধ্যে এবং আল্লাহর মহব্বতে আত্মীয়স্বজন, পিতৃহীন, অভাবগ্রস্ত, মুসাফির, সাহায্য প্রার্থীগণকে এবং দাসমুক্তির জন্য অর্থদান করার মধ্যে। সালাত কায়েম, জাকাত প্রদান এবং প্রতিশ্রুতি দিয়ে তা পূর্ণ করাসহ অর্থ সংকটে, দুঃখ ক্লেশে ও সংগ্রাম সংকটে ধৈর্য ধারণ করলে এরাই তারা যারা সত্যপরায়ণ এবং তারাই মুত্তাকি। (সুরা বাকারা আয়াত-১৭৭)।

মানবসেবার গুরুত্ব প্রসঙ্গে রসুলুল্লাহ (সা.) বলেন : প্রত্যেক কওমের নেতা সফর অবস্থায় দলের খাদেম থাকবে। যে ব্যক্তি খেদমতের ক্ষেত্রে তাদের মধ্যে অগ্রগামী হবে কেউ তাকে আমলের মাধ্যমে পেছনে ফেলতে পারবে না, তবে অবশ্য শহীদ ব্যক্তি তা পারবে। (বায়হাকি)। জনসেবা এবং মানব খেদমতের মূর্ত প্রতীক ছিলেন প্রিয় নবী মুহাম্মদুর রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। সেবার এ গুণটি তাঁর মধ্যে নবুওয়াত প্রাপ্তির আগেও বিদ্যমান ছিল। প্রথম ওহিপ্রাপ্ত হয়ে তিনি ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়লেন এবং এ ঘটনা হজরত খাদিজাতুল কুবরার (রা.) কাছে বর্ণনা করলেন। তখন তিনি নিম্নোক্ত বাণী দ্বারা প্রিয় নবী, বিশ্বনবী, প্রাণপ্রিয় স্বামী মুহাম্মদুর রসুলুল্লাহ (সা.)-কে সান্ত্বনা দিলেন। আল্লাহর শপথ আল্লাহ কখনো আপনাকে লাঞ্ছিত করবেন না, কেননা আপনি আত্মীয়ের প্রতি সদাচরণ করেন, অসহায় ব্যক্তির বোঝা বহন করেন, নিঃস্ব ব্যক্তির খাদ্য-বস্ত্রের ব্যবস্থা করে দেন, মেহমানের আপ্যায়ন করেন এবং বিপদগ্রস্ত মানুষের প্রতি সহায়তা দান করেন। (বোখারি শরিফ)। মূল কথা হলো- ইসলাম মানুষের সেবা ও খেদমতের নিমিত্তে সমাজের উপকারের জন্য নিজের যথা সর্বস্ব বিলিয়ে দিতে উদ্বুদ্ধ করে, যাতে সমাজ থেকে অশান্তি, অবজ্ঞা, অবহেলা, নিষ্ঠুরতা, জুলুম, অত্যাচার, অবিচার ও দারিদ্র্য দূর হয়ে নেমে আসে সমাজজীবনে শান্তির ফল্গুধারা। ইসলাম শুধু মানুষের সেবার প্রতিই উদ্বুদ্ধ করে না, বরং আল্লাহর সব সৃষ্টির প্রতি সেবাদানের ব্যাপারে অনুপ্রাণিত করে। প্রিয় নবী ইরশাদ করেন : যারা অন্যের প্রতি দয়া করে, রহমান অতি দয়াবান প্রভু তাদের প্রতি দয়া করেন। সুতরাং পৃথিবীতে বসবাসকারী সমস্ত সৃষ্টির প্রতি তোমরা রহম কর। তাহলে আকাশের অধিষ্ঠিত প্রভুও তোমাদের প্রতি রহমত বর্ষণ করবেন, (তিরমিজি)। প্রিয় নবী আরও ইরশাদ করেন : সমস্ত সৃষ্টি আল্লাহর পরিবারভুক্ত। সুতরাং সৃষ্টির মধ্যে উত্তম ওই ব্যক্তি, যে আল্লাহর পরিবারভুক্তদের প্রতি সদাচরণ করে। (মিশকাত)। প্রিয় নবী মুহাম্মদ রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন : তোমাদের পূর্বেকার জমানায় একজন অতি নিকৃষ্ট গুনাহগার মহিলা মরুভূমির পিপাসার্ত একটি কুকুরকে তার পায়ে পরিহিত চামড়ার মোজা দিয়ে কুয়া থেকে পানি উঠিয়ে পানি পান করিয়ে সেই কুকুরটির জীবন রক্ষা করেছিল। মহান রব্বুল আলামিন তার এ আমলে সন্তুষ্ট হয়ে তার জীবনের সব গুনাহ মাফ করে তাকে জান্নাত দান করেন। অপর একজন দীনদার নেক্কার মহিলা তার গৃহপালিত বিড়ালকে বেঁধে রেখে কোনো খাবার না দিয়ে কষ্ট দিয়ে হত্যা করার অপরাধে তার সব নেকি নষ্ট হয়ে যায় এবং সে জাহান্নামি হয়ে যায়। (বোখারি শরিফ)। প্রিয় নবী আরও ইরশাদ করেন : তোমরা হালাল প্রাণীকে জবাই করার সময় কোনো প্রকার কষ্ট যেন না হয় সেদিকে খেয়াল রাখ। তাই ভালো করে বেঁধে ধারালো ছুরি দিয়ে অল্প সময়ের মধ্যে আল্লাহু আকবার বলে জবাই করবে। বিনা প্রয়োজনে কোনো ছোট্ট একটি পশুকেও হত্যা করতে নিষেধ করেছেন। কেননা সৃষ্টির সেবা ও কল্যাণ কামনা করাও একটি বিশেষ ইবাদত।
লেখক : ইসলামবিষয়ক গবেষক, ইমাম ও খতিব, কাওলারবাজার জামে মসজিদ, দক্ষিণ, ঢাকা

পিএনএস/আনোয়ার

@PNSNews24.com

আপনার মন্তব্য প্রকাশ করুন