পিএনএস ডেস্ক: মাতৃভাষার প্রতি ভালোবাসা ফিতরাত তথা স্বভাবজাত বৈশিষ্ট্যের অন্তর্ভুক্ত। মাতৃভাষার মাধ্যমে মানুষের অনুভূতিপ্রবণ মন বিচিত্রভাবে প্রকাশ পায়। আমাদের পূর্বসূরিদের অভিজ্ঞতা, সাধনা, ত্যাগ-তিতিক্ষাগুলোর কথা আমরা ভাষার মাধ্যমে জানতে পেরেছি।
মানুষের অনন্ত জ্ঞান-পিপাসা নতুন নতুন জানার জগৎকে আবিষ্কার করছে। জ্ঞান-বিজ্ঞানের এ অসীম জগতে প্রবেশের জন্য ভাষার মাধ্যম খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ভাষা ছাড়া সুস্থ ও পরিপূর্ণ জীবনযাপন কল্পনাও করা যায় না। আল্লাহতায়ালা প্রথম মানব হজরত আদম (আ.)কে ভাষাজ্ঞানী ও বাকশক্তির অধিকারী করে পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন।
হজরত আদম (আ.)-কে সৃষ্টির পরে আল্লাহতায়ালা বলেছেন, আর তিনি আদমকে সবকিছুর নাম শিক্ষা দিয়েছেন, তারপর সমুদয় ফেরেশতাদের সম্মুখে প্রকাশ করলেন। অতঃপর বললেন, এ সমুদয়ের নাম আমাকে বলে দাও, যদি তোমরা সত্যবাদী হও। (সূরা বাকারা-৩১)। ওই আয়াতে বর্ণিত ‘এ সমুদয়ের নাম আমাকে বলে দাও’-এর ব্যাখ্যায় আল্লামা মাহমুদ আলুসী (রহ.) বলেন, এর দ্বারা পৃথিবীর সব ভাষাকে বোঝানো হয়েছে, যা আল্লাহতায়ালা হজরত আদম (আ.)-কে শিক্ষা দিয়েছিলেন। (তাফসিরে রুহুল মা’আনী-খ: ১, পৃ.-২৬১)।
কালের ধারাবাহিকতায় আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রেরিত নবি-রাসূলরা বিশুদ্ধ ভাষায় কথা বলতেন। হজরত মুহাম্মাদ (সা.)-এর ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম ছিল না। তিনি বলেন, ‘আমি আরবদের মধ্যে সবচেয়ে শুদ্ধভাষী।’ বিশুদ্ধ মাতৃভাষায় কথা বলা প্রিয় নবিজির সুন্নত। প্রিয় নবিজি (সা.)-এর বিশুদ্ধ ভাষা ও উন্নত বাচনভঙ্গি সবাইকেই বিস্মিত করত।
কেননা, তার ভাষার অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল, তিনি খুব কম শব্দে বেশি অর্থবোধক কথা বলতে পারতেন। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূল (সা.) বলেছেন, অল্প শব্দে ব্যাপক অর্থবোধক বাক্য বলার শক্তিসহ আমাকে পাঠানো হয়েছে এবং শত্রুর মনে ভীতি সঞ্চারের মাধ্যমে আমাকে সাহায্য করা হয়েছে। (বোখারি-২৯৭৭)।
নবিজি (সা.) তিনি নিজেই বিশুদ্ধ উচ্চারণের প্রতি গুরুত্ব দিতেন। তৎকালীন আরবের বেদুইনরা ছিলেন সবচেয়ে শুদ্ধভাষী। তাই সম্ভ্রান্ত আরব বংশের ছেলেদের মাতৃভাষায় পারদর্শী হওয়ার জন্য তারা বেদুইন গোত্রগুলোর কাছে প্রেরণ করতেন। আমাদের নবিও আরবের সবচেয়ে বিশুদ্ধভাষী ‘বনু সাদ’ গোত্রে হজরত হালিমা সাদিয়ার কাছে প্রায় ৫ বছর অবস্থান করেন। মায়ের সেবার মতো মাতৃভাষাকেও তিনি সেবা করেছেন। ইমাম বোখারি (রহ.) বর্ণনা করেছেন হজরত ওমর (রা.) বলেছেন, উচ্চারণের ভুল তীর নিক্ষেপের ভুলের চেয়েও মারাত্মক। (বোখারি-৮৮৯)।
একবার এক সাহাবি ঘরে প্রবেশের জন্য অনুমতি চেয়ে বলেন, আ-আলুজু? তখন প্রিয়নবি (সা.) তার খাদেমকে বলেন, যাও! লোকটিকে ঘরে প্রবেশের নিয়ম শিখিয়ে দাও। সে যেন বলে আ-আদুখুলু (আবু দাউদ)। এখানে আলোচনার বিষয় হলো ‘আলুজু’ ও ‘দুখুলু’ শব্দ দুটি একই অর্থ প্রকাশ করে। কিন্তু ‘দুখুলু’ শব্দটির সাহিত্যিক মর্যাদা অনেক ওপরে। তাই নবিজি তাকে সেটি বলতে বলেছেন।
নবিজির সাহাবিরা এবং পরবর্তী সময়ে তাবেয়িরা তাদের সন্তানদের শুদ্ধভাবে মাতৃভাষা চর্চার জন্য শাসনও করতেন। ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (রহ.) তার মেয়েকে শুদ্ধ উচ্চারণের তাগিদ দিতেন। এমনকি শুদ্ধ উচ্চারণের জন্য মৃদ শাস্তিও দিতেন। ইমাম মুসলিম (রহ.) মুসলিম শরিফে ‘কিতাবুল আলফাজ’ বা বিশুদ্ধ শব্দ উচ্চারণ নিয়ে একটি অধ্যায় লিপিবদ্ধ করেছেন।
হজরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) থেকে বর্ণিত রাসূল (সা.) এরশাদ করেছেন, তোমরা এশার নামাজকে ‘আতামা’ বল না বরং ‘এশা’ বল। অনুরূপভাবে প্রিয় নবিজি (সা.) সামাজিক পরিবেশে যথাযথ শব্দ ব্যবহারের জন্য নির্দেশ দিয়েছেন। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূল (সা.) বলেছেন, তোমাদের কেউ আমার ‘আবদ’ ও ‘আমাত’ (আমার বান্দা, আমার বাঁদি) বলবে না।
কেননা, তোমাদের প্রত্যেক পুরুষই আল্লাহর বান্দা এবং তোমাদের প্রত্যেক মহিলাই আল্লাহর বাঁদি; বরং বলবে ‘গোলামি ওয়া জারিয়াতি ওয়া ফাতায়া ওয়া ফাতাতি’ (অর্থাৎ আমার বালক-কিশোর, আমার বালিকা-কিশোরী, আমার সেবক, আমার সেবিকা)। (মুসলিম-৫৬৭৮)। অপর হাদিসে নবিজি (সা.) বলেছেন, তোমরা আঙুরকে ‘আল কারাম’ বল না বরং ‘আল হাবালাহ’ বল। (মুসলিম-৫৬৭৭, ৫৭৬৫)।
ভাষার বিকৃতি ইসলামে কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। পূর্ববর্তী আহলে কিতাবের কেউ কেউ তাদের মুখ চিবিয়ে বিকৃত উচ্চারণ করে ভাষাগত জটিলতা সৃষ্টি করত। তাদের প্রসঙ্গে আল্লাহতায়ালা বলেন, আর তাদের মধ্যে একদল রয়েছে যারা বিকৃত উচ্চারণে মুখ বাঁকিয়ে কিতাব পাঠ করে, যাতে তোমরা মনে কর তারা কিতাব থেকে পাঠ করছে। অথচ, তারা যা পাঠ করছে, তা আদৌ কিতাব নয় এবং তারা বলে এসব কথা আল্লাহর পক্ষ থেকে নাজিলকৃত। অথচ, এসব আয়াত আল্লাহর পক্ষ থেকে অবতীর্ণ নয়। তারা জেনেশুনে আল্লাহর প্রতি মিথ্যারোপ করে। (সূরা আলে ইমরান-৭৮)।
ইসলাম এমন একটি জীবনব্যবস্থা, যেখানে শুধু মাতৃভাষা নয় বরং মাতৃভাষার আঞ্চলিকতা বা উপভাষাকে সমর্থন করা হয়ে থাকে। এজন্য কুরআন তেলাওয়াতে সাতটি পঠনরীতি প্রচলিত রয়েছে। রাসূল (সা.) বলেছেন, নিশ্চয়ই কুরআন সাত হরফে বা উপভাষায় অবতীর্ণ হয়েছে। অতএব, ওইসব ভাষার মধ্যে যে ভাষাটি সহজ হয়, সে ভাষাতেই তোমরা তেলাওয়াত কর। (বোখারি-২২৮৭)।
মহানবি (সা.) যখন মদিনায় হিজরত করেন, তখন তিনি দেখলেন আশপাশে প্রচুর সংখ্যক ইহুদির বসবাস। ইহুদিদের ভাষা সুরিয়ানি হওয়ায় তাদের সঙ্গে পত্র বিনিময়কালে নানারকম সমস্যা দেখা দিল। জাতি হিসাবে তারা ছিল অত্যন্ত ধূর্ত। ফলে মহানবি (সা.) হজরত জায়েদ ইবনে সাবিত (রা.)কে নির্দেশ দিলেন ইহুদিদের ভাষা শিখতে। যাতে করে তাদের মাতৃভাষায় চিঠিপত্র বিনিময় করা যায়। মহানবি (সা.) যখন মদিনায় হিজরত করলেন, তখন হজরত জায়েদ বিন সাবিত (রা.) ১১ থেকে ১২ বছরের তরুণ।
মহানবি (সা.) তাকে বলেন, হে জায়েদ! আমার কাছে বিভিন্ন ভাষার চিঠিপত্র আসে। আমি চাই না, সবাই তা পড়ুক। তুমি কি হিব্রু অথবা সুরিয়ানি ভাষা শিখতে পারবে? তখন আমি মাত্র ১৫ বা ১৭ দিনের মধ্যে তাদের ভাষা শিক্ষা গ্রহণ করি। (কানযুল উম্মাল-৩৭০৫৯)। হজরত জায়েদ ইবনে সাবিত (রা.) বলেন, এরপর মহানবি (সা.) ইহুদিদের কিছু লিখতে চাইলে আমি তাদের ভাষায় লিখে দিতাম এবং তারা কিছু লিখলে আমি তা পড়ে শুনাতাম।
রাসূল (সা.) আরবিকে মাতৃভাষা হিসাবে অত্যধিক পছন্দ করতেন। তিনি বলেছেন, ‘তোমরা তিন কারণে আরবিকে ভালোবাস। কেননা, আমি আরবি (আরবি আমার মাতৃভাষা), কুরআন আরবি আর জান্নাতিদের ভাষাও আরবি।’
পিএনএস/এমএইউ
মাতৃভাষা চর্চা করতেন মহানবী (সা.)
09-02-2024 01:02PM