ডোনাল্ড লু’র সফর গভীর পর্যবেক্ষণে আ’লীগ

  17-05-2024 10:00AM




পিএনএস ডেস্ক: তিন দিনের সফর শেষে গতকাল ভোরে ঢাকা ছেড়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লু। তার বাংলাদেশ সফরের আগে সরকারি দল আওয়ামী লীগের মধ্যে বেশ অস্বস্তি কাজ করে। অবশ্য দল ও সরকারের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের নেতাদের সাথে লু’র বৈঠক এবং পরবর্তীতে আনুষ্ঠানিক ব্রিফিং শেষে কিছুটা স্বস্তি ফিরেছে শাসক দলে। তার বক্তব্যকে ইতিবাচকভাবে দেখলেও এখনই সেটাকে সাফল্য হিসেবে দেখছে না ক্ষমতাসীনরা। তা ছাড়া বাংলাদেশের সাথে সম্পর্কোন্নয়নের কথা বললেও নির্বাচন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র তাদের অবস্থান পরিবর্তন করেছে কি না তা এখনো সরকারি দলের কাছে স্পষ্ট নয়। এজন্য লু’র সফর আরো গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছে শাসক দল। আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী ও মধ্যমসারির একাধিক নেতার সাথে আলাপকালে এসব কথা জানা গেছে।

নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের এক নেতা আলাপকালে বলেন, বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি হলো সবার সাথে বন্ধুত্ব, কারো সাথে বৈরিতা নয়। নির্বাচন ও মানবাধিকার নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র কিছু প্রশ্ন তুললেও এখন সরকারের সাথে সম্পর্কোন্নয়ন করতে আগ্রহী। সরকারও যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সম্পর্ক দৃঢ় করতে চায়। যুক্তরাষ্ট্র সবসময় তাদের স্বার্থে প্রত্যেক দেশেই কাজ করে। তাদের স্বার্থের বাইরে গিয়ে অন্য কোনো দল বা গোষ্ঠীকে সমর্থন করে না।

ওই নেতা আরো বলেন, ডোনাল্ড লু সফরে এসেছেন যুক্তরাষ্ট্রের ইচ্ছায়। সরকার তাকে দাওয়াত করে আনেনি বা আমন্ত্রণও জানায়নি। তার আগমনে বিরোধী দলে কিছুটা উৎফুল্লতা দেখা গেছে। লু’ চলে যাওয়ার পর বিরোধী শিবিরের অবস্থান ও গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। তার সফরে বিএনপি-জামায়াতের মধ্যে নতুন কোনো পরিবর্তন আসছে কি না সেটা দেখার বিষয় রয়েছে। এজন্য মূলত লু’র সফর শেষ হলেও আরো পর্যবেক্ষণ রয়েছে। কিছু দিন গেলেই পর্যবেক্ষণের ফলাফল বলা সম্ভব হবে। শীর্ষ আরেক নেতা বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের সাথে কিছু বিষয়ে ভুল বোঝাবুঝি ছিল যা এ দেশের কিছু বুদ্ধিজীবী তৈরি করেছিল। এখন আর সেটি নেই। যুক্তরাষ্ট্র বুঝতে পেরেছে জনগণ এ সরকারের সাথেই আছে।

এ প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের অন্যতম যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম গতকাল বলেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একজন গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী সফর করে গেলেন। তিনি যৌথ ব্রিফিংয়ে বাংলাদেশ সরকারের সাথে সম্পর্কোন্নয়নের কথা বলেছেন, সরকারের সাথে কাজ করার কথা বলেছেন। আমরা এটাকে ইতিবাচক হিসেবেই দেখি। তাদেরকে যে ভুল বোঝানো হয়েছে তারা ইতোমধ্যে সেটা বুঝতে পেরেছে। যুক্তরাষ্ট্র কেন কোনো দেশই আমাদের শত্রু নয়। সবার সাথে আমাদের বন্ধুত্ব।

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, মির্জা ফখরুল সাহেব নিশ্চয় ডোনাল্ড লু’র সাথে বৈঠক করেননি। তাহলে তিনি কীভাবে বুঝতে পারলেন, যুক্তরাষ্ট্র আগের অবস্থানে রয়েছেন! এটা হলো তাদের রাজনৈতিক দেউলিয়াত্ব। তারা অন্যের ওপর ভর করে ক্ষমতায় আসতে চেয়েছিল। কিন্তু দেশের জনগণ সেটা রুখে দিয়েছে। আমার মনে হয়, নেতাকর্মীদের চাঙা রাখার জন্য মির্জা ফখরুল সাহেবরা এ ধরনের উল্টাপাল্টা বক্তব্য দিয়ে থাকেন।

আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ড. আব্দুর রাজ্জাক মনে করেন, কিছু বিষয়ে ‘অস্বস্তি’ থাকলেও এখন দু’দেশের সম্পর্ক আরো সামনে এগিয়ে যাবে। আমরা জানি যুক্তরাষ্ট্র শক্তিশালী দেশ এবং বিশ্ব রাজনীতি ও অর্থনীতিতে তারা নেতৃত্বে দেয়। সব জায়গায় তাদের রাজনৈতিক স্বার্থ আছে। আগে নির্বাচন বা গণতন্ত্র বা বৈধতা নিয়ে তাদের প্রশ্ন ছিল। মানবাধিকার নিয়েও তাদের বক্তব্য ছিল। কথা বলার স্বাধীনতা নিয়ে পর্যবেক্ষণ ছিল। এখন তারা দেখছে জনগণ সরকারের সাথেই আছে। তাদের বর্তমান অবস্থান বাংলাদেশের জন্য ভালো হবে। ডোনাল্ড লু যুক্তরাষ্ট্র সরকারের যে অবস্থান ব্যক্ত করেছেন তাতে যুক্তরাষ্ট্রের মিত্রদের সাথেও বাংলাদেশে সম্পর্ক আরো ঘনিষ্ঠ হওয়ার সুযোগ তৈরি হবে। আমি আশা করি, আগামী দিনে দু’দেশের সম্পর্ক আরো ভালো হবে। সব বিষয়ে উভয় দেশ একযোগে কাজ করতে সমর্থ হবে।

ডোনাল্ড লু সফরে এসে সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্নপর্যায়ের কয়েকটি বৈঠক এবং মতবিনিময় সভায় অংশ নেন। গত মঙ্গলবার ঢাকা পৌঁছে তিনি নাগরিকসমাজ, সাংবাদিক ও পরিবেশকর্মীদের সাথে বৈঠক করেন। রাতে প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানের বাসভবনে বৈঠক করেন। সেখানেই ছিল নৈশভোজের আয়োজন।

পরের দিন বুধবার, তিনি পররাষ্ট্র সচিব, পরিবেশ মন্ত্রী এবং পররাষ্ট্র মন্ত্রীর সাথেও বৈঠক করেন। যৌথ ব্রিফিংয়ে ডোনাল্ড লু বলেন, বাংলাদেশের সাথে সম্পর্কোন্নয়ন চায় যুক্তরাষ্ট্র। বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচন ঘিরে ঢাকার সাথে ওয়াশিংটনের সম্পর্কে ‘অনেক টেনশন’ তৈরি হয়েছিল উল্লেখ করে ডোনাল্ড লু বলেন, এসব সরিয়ে বাংলাদেশের সাথে সম্পর্কের ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র সামনে তাকাতে চায়, পেছনে নয়। ডোনাল্ড লু আরো বলেন, বাংলাদেশ সফরে এসে গত দুই দিনে আমি দুই দেশের জনগণের মধ্যে পুনরায় আস্থা স্থাপনের চেষ্টা করছি। আমরা জানি, গত বছর বাংলাদেশের সাথে আমাদের অনেক টেনশন ছিল। আমরা অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন অনুষ্ঠানে যথেষ্ট চেষ্টা করেছিলাম। এতে কিছু টেনশন তৈরি হয়েছিল। আমাদের সম্পর্কের ক্ষেত্রে এটা স্বাভাবিক।

সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, ২০২১ সালের ডিসেম্বরে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে এলিট ফোর্স রথ্যাবের ওপর নিষেধাজ্ঞা আসলে বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যকার সম্পর্ক নিয়ে টানাপড়েন তৈরি হয়। এরপর কখনো ভিসানীতি, কখনো বা শক্ত ভাষায় মিত্রদের চাপ, পূর্ণাঙ্গ পর্যবেক্ষক না পাঠানোর ঘোষণা- এমন অনেক প্রক্রিয়ায় সরকারের ওপর নজিরবিহীন চাপ তৈরি করেছিল যুক্তরাষ্ট্র, যা নিয়ে সরকারি দল আওয়ামী লীগের শীর্ষপর্যায় থেকে বারবার ক্ষোভ প্রকাশ করা হয়েছিল। বিশেষ করে রথ্যাবের নিষেধাজ্ঞায় বিপাকে পড়ার মধ্যে ২০২৩ সালের ২৫ মে যুক্তরাষ্ট্র নির্বাচন সামনে রেখে ভিসানীতি ঘোষণা করলে আওয়ামী লীগ সরকার নজিরবিহীন চাপে পড়ে।

দলটির মধ্যম সারির একাধিক নেতা বলেন, নির্বাচনের আগে যুক্তরাষ্ট্র আওয়ামী লীগ সরকারের ওপর নানাভাবে ব্যাপক চাপ দিলেও এখন দেখছে শেখ হাসিনার সরকার বিশ্বের অনেক দেশের কাছেই প্রশংসিত হচ্ছে। উন্নয়ন ও অগ্রগতিতে বাংলাদেশ বিশ্বের অন্যান্য দেশের কাছে একটি রোল মডেল হিসেবে অভিহিত হচ্ছে। সেই জায়গা থেকে যুক্তরাষ্ট্র হয়তো সরকারের সাথে কাজ করতে আগ্রহী। কিন্তু ভেতরে ভেতরে তাদের পরিকল্পনা কি এখনো দৃশ্যমান নয়। তারা কি চায় সেটা জানতে হলে আরো অপেক্ষা করতে হবে। নির্বাচনের আগে বিএনপিসহ সরকারবিরোধী শক্তিকে এক প্রকার শক্তি জুুগিয়েছে রাষ্ট্রদূত পিটার হাস। তিনি অনেক দৌড়ঝাঁপ দিয়েছেন। লু সফর করেও সরকারকে কৌশলে চাপ প্রয়োগ করেছে। ফলে এখনই তার বক্তব্য পুরোপুরি নির্ভর করা যায় না। তবে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের নীতিতে যে কিছুটা তার অবস্থান পরিবর্তন করেছে লুর চলে যাওয়ার আগে তার ব্রিফিং থেকে অনুধাবন করা যায়। তবে আরো কিছুদিন গেলে বিষয়টি আরো পরিষ্কার হয়ে যাবে।

যদিও যুক্তরাষ্ট্র তার আগের অবস্থানে রয়েছে বলে মনে করে মাঠের প্রধানবিরোধী দল বিএনপি। দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশ প্রসঙ্গে আগের অবস্থানে আছে। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের এমন বক্তব্যের জবাবে গতকাল আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেন, মির্জা ফখরুল কি করে জানলেন যুক্তরাষ্ট্র তার আগের অবস্থানে রয়েছে? মার্কিন সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লুর বক্তব্য পরিষ্কার। তিনি যে কথা বলেছেন, এরপর ফখরুল সাহেবের যে বক্তব্য, এ বক্তব্যের কোনো মূল্য নেই।


পিএনএস/আনোয়ার


@PNSNews24.com

আপনার মন্তব্য প্রকাশ করুন