মন্ত্র দিয়ে বিষ টানাটানি খেলা

  22-10-2017 08:18PM

পিএনএস, তানোর (রাজশাহী) প্রতিনিধি : মাঠের চারপাশি উৎসুক দর্শক। কখন শুরু হবে ‘বিষ টানাটানি খেলা। মাঠের চারিপাশে বসা কবিরাজদের (ওঝা) দল আসন গেড়ে বসে আছে। মাঠের মাঝে তিন যুবকের শরীরে অপশক্তি ভর করিয়ে ছেড়ে দেয়া হয়েছে। এরপর শুরু কবিরাজ দলের মন্ত্র পাঠ। চলে কবিরাজদের মধ্যে প্রতিযোগিতা। মন্ত্র পড়ে ওই তিন জনকে নিজের সীমানায় টেনে আনতে যে আগে পারবে সেই জয়ী। চলছে অনাবরত মন্ত্র পাঠ। মাঠের বাইরে হাজারো দর্শক আগ্রহ ভরে কবিরাজদের কেরামতি দেখছে। চরম উত্তেজনা। কে জয়ী হবেন? কার মন্ত্রের শক্তি বেশি। খেলাটির নাম ‘বিষ টানাটানি’ খেলা।

আদিবাসীদের মধ্যে বিষ টানাটানি খেলাতে আগ্রহ অনেক বেশি দেখা যায়। আগে অনেক উৎসবে খেলাটি দেখা যেতো। বরেন্দ্র অঞ্চলের সমাতল আদিবাসীরা প্রতি বছরের আশ্বিন-কার্তিক মাসে মনষা পূজাসহ নানা উৎসব উপলক্ষে বিষ টানাটানি খেলায় আয়োজন করতো। তবে আধুনিকতার ছোঁয়ায় এ খেলার আয়োজন কমে এসেছে অনেকটা।

সমাতল আদিবাসীদের অনেক ঐতিহ্যের এই খেলা। কয়েক দশক আগে বিভিন্ন উৎসবে এ ধরণের খেলা প্রায় দেখা গেলেও এখন সেসব প্রায় স্মৃতি হতে বসেছে। আদিবাসীদের হারিয়ে যাওয়া বিষ টানাটানি খেলাটির দেখা মিললো গত সোমবার রাজশাহীর তানোর উপজেলার শিবরামপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠে। এখানকার মানুষ প্রতি বছর এ খেলাটির আয়োজন করেন।

শিবরামপুর শ্রী শ্রী মনষা পূজা উপলক্ষে বিষ টানাটানি খেলাটি প্রতি বছরের ন্যায় এবারো আয়োজন করেছিলেন পূজা কমিটির লোকজন। বিকাল ৪টা থেকে একটানা চলে সাড়ে তিন ঘণ্টা পর্যন্ত। খেলাটিতে অংশ গ্রহন করেন আশেপাশের উপজেলা থেকে আসা সাতটি ওঝার দল।

শিবরামপুর পূজা কমিটির সভাপতি দয়াল চন্দ্র মাহাতো জানান, বিষ টানাটানি মুলতো অপশক্তির ভরকে অপশক্তির মন্ত্র দিয়ে টানার প্রতিযোগিতা খেলা। এটি অন্য সব খেলার চেয়ে আদিবাসীদের কাছে বেশি বিশ্বাসযোগ্য ও আনন্দের। তাই খেলাটি দেখার আগ্রহ বেশি হওয়াই বিভিন্ন গ্রাম থেকে হাজার হাজার নারী-পুরুষ জমা হয় খেলাটি উপভোগ করার জন্য।

দয়াল চন্দ্র মাহাতো আরো জানান, বিষ টানাটানি খেলা শুরুর আগে মাঠের ঠিক মাঝখানে ছোট একটি বৃত্ত কাটা হয় ও তার মাঝে একটি কলা গাছ লাগানো হয়। সেখানে কমিটির পক্ষে তিন জনের শরীরে অপশক্তি ভর (তাদের ভাষ্য অনুযায়ি মরা সাপের বিষ) তুলে দিয়ে ছেড়ে দেয়া হয়। সে অপশক্তি ভরকে মাঠের বাইরে থাকা ওঝার দলেরা বিভিন্ন মন্ত্র দিয়ে নিজেদের সিমানায় টানার চেষ্টা করে থাকে। যে ওঝা যতো বেশি জনকে নিজের সীমানায় আনতে পাবরে সেই বিজয়ী হবেন। যে বিজয়ী হতে সে ওঝার জন্য তা গর্ভের বিষয়। শুধু তাই না, আদিবাসী গ্রামগুলোতে ওই বিজয়ী ওঝার দামও অনেক বেড়ে যায়।

খেলা শুরুর আগে কমিটির পক্ষের ওঝা বিশ্বনাথ হেমরন ও সংকর বর্মন তাদের মন্ত্র শক্তি দিয়ে সুশিল হেমরণ, জোসনা টুডু ও বাদল মাহতো শরীরে অপশক্তির ভর করিয়ে দেয়। এরপরে তাদের মাঠে ছেড়ে দেয়া হয়। চারি দিকে ওঝার দলেরা মন্ত্র দিয়ে তাদের তিন জনকে নিজের কাছে টানার চেষ্টা করেন। ওই তিন জনকে যে ওঝা তার সীমানার মধ্যে যতো বার আনতে পারবে ততোবারই পাবে একটি করে পয়েন্ট।

শিবরামপুর গ্রামে ওই বিষ টানাটানির খেলায় বিজয়ী হয়েছেন নাচোল উপজেলার কসবা গ্রাম থেকে সাদিকুলের ও তার দল। তারা পেয়েছেন মোট ৩২ পয়েন্ট। ২৪ পয়েন্ট পেয়ে নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী হয়েছেন একই উপজেলার ফতেপুর গ্রামে থেকে আসা পশুরাম ও তার দল।

খেলা শেষে বিজয়ীদের নাম ঘোষনা করেন বাধাইড় ইউপির ওয়ার্ড সদস্য ও পূজা কমিটির অন্যতম সদস্য ভঞ্জন চন্দ্র মাহাতো। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন বাধাইড় ইউপি চেয়ারম্যান আতাউর রহমান। উপস্থিত ছিলেন মুন্ডুমালা পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রের ইনচার্জ ওসি তদন্ত সিদ্দিকুর রহমানসহ বাধাইড় ইউপির সকল সদস্যসহ এলাকার মানুষ।

প্রধান অতিথি জয়ী ওঝার দলকে প্রথম পুরষ্কার হিসেবে একটি ২১ ইঞ্চি রঙিন টেলিভিশন ও দ্বিতীয় স্থান অধিকার করা দলের হাতে তুলে দেয়া হয় একটি সাউন্ডবক্স।

তানোর উপজেলা মুন্ডুমালা উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ও তানোর আদিবাসি পারগানা পরিষদের সভাপতি মি.কামেল মার্ডী জানান,শুধু মন্ত্র দিয়ে বিষ টানাটানি খেলায় নয়, আদিবাসীদের অনেক ঐতিহ্যের খেলা ও সংস্কৃতি হারিয়ে যেতে বসেছে। এসব টিকিয়ে রাখতে হলে আদিবাসিদের বিভিন্ন সংগঠনদের এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়েছেন তিনি।

পিএনএস/মোঃ শ্যামল ইসলাম রাসেল


@PNSNews24.com

আপনার মন্তব্য প্রকাশ করুন