অ্যাপের মাধ্যমে জানা যাবে ফসলে কী পরিমাণ সার প্রয়োজন

  27-01-2024 01:56PM



পিএনএস ডেস্ক: পরিমিত পরিমাণে সারের ব্যবহার যে কোনো ফসলের জন্যে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ফসল অনুযায়ী একটি জমিতে কী পরিমাণ সার প্রয়োজন তা নির্ণয়ের জন্যে 'নিউট্রিয়েন্ট ব্যালেন্স' নামে একটি মোবাইল অ্যাপ নিয়ে কাজ করছেন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) একদল গবেষক। তাদের উদ্ভাবিত এই অ্যাপটির মাধ্যমে আলু, বোরো ধান, রোপা আউশ ধান, রোপা আমন এবং ভূট্টা এই পাঁচটি ফসলের ক্ষেত্রে কী পরিমাণ সার কম বা বেশি আছে সেটি জানতে পারবেন কৃষক।

ফসলের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ মৌলিক পুষ্টি উপাদানগুলো হলো নাইট্রোজেন (এন), পটাশিয়াম (কে), ফসফরাস (পি) এবং সালফার (এস), যা সার হিসেবে ব্যবহৃত হয়। মাটিতে এসব উপাদান ফসলের প্রয়োজন অনুযায়ী পরিমিত পরিমাণে থাকলেই কাঙ্ক্ষিত উৎপাদন সম্ভব। ফসলে সারের সঠিক পরিমাণ নিশ্চিতের লক্ষ্যেই 'নিউট্রিয়েন্ট ব্যালেন্স' অ্যাপের তৈরি।

প্রকল্পের প্রধান গবেষক বাকৃবির মৃত্তিকা বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. মফিজুর রহমান জাহাঙ্গীর জানান, 'ডেভেলপমেন্ট অফ এ ফিল্ড লেভেল স্কেল নিউট্রিয়েন্ট ব্যালেন্স ক্যালকুলেটর ফর ক্রপস অফ অ্যান ইনটেনসিভলি ম্যানেজড এগ্রিকালচারাল সিস্টেম' শীর্ষক প্রকল্পের আওতায় ২০২০ সালের অক্টোবর মাসে এই গবেষণা কার্যক্রম শুরু হয়। যেখানে সহকারী গবেষক হিসেবে কাজ করেছেন মৃত্তিকা বিজ্ঞান বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক ড. মো. জহির উদ্দীন।

২০২৩ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত মোট তিন বছরের ওই গবেষণা প্রকল্পের অর্থায়ন করেছে বাংলাদেশ বিজ্ঞান একাডেমি (বিএএস) এবং ইউনাইটেড স্টেটস ডিপার্টমেন্ট অফ এগ্রিকালচার (ইউএসডিএ)।

অ্যাপটির অধিকতর উন্নয়ন করে কৃষকদের মাঝে সম্প্রসারণের লক্ষে প্রকল্পটি আরও এক বছরের জন্যে বর্ধিতও করা হয়েছে। ইতোমধ্যে আর্কাইভস অব এগ্রোনমি এন্ড সয়েল সায়েন্স নামক আন্তর্জাতিক জার্নালে এই অ্যাপের গবেষণা সম্বলিত দুইটি প্রকাশনা প্রকাশিত হয়েছে এবং জার্নাল অব ইন্ট্রিগেটিভ এনভাইরনমেন্টাল সায়েন্সে একটি প্রকাশনা গৃহীত হয়েছে।

গাছের সঠিক পুষ্টিমাত্রার প্রয়োজনীয়তা নিয়ে গবেষক বলেন, ইউরিয়া, মিউরেট অব পটাশ (এমওপি), ট্রিপল সুপার ফসফেট (টিএসপি) এবং জিপসাম সার ব্যবহার করে এসব পুষ্টির উপাদানের ঘাটতি পূরণ করা হয়। তবে ফসল উৎপাদনের জন্যে পরিমিত সার কতোটুকু তা আমাদের কৃষকদের এখনও অজানা। এখন পূর্বপুরুষদের প্রচলিত নিয়মানুযায়ীই কোনোরকম নিয়মতান্ত্রিক হিসেব ছাড়াই জমিতে বিভিন্ন সার দিয়ে থাকেন কৃষক।

ফলস্বরূপ প্রয়োজনের অধিক সার প্রয়োগ যেমন খরচ বাড়ায় তেমনি তৈরি করে মাটি ও পরিবেশে বিষক্রিয়া। আবার সারের পরিমাণ কম হলে পুষ্টির অভাবে ফলন কম থেকে শুরু করে গাছ মারাও যেতে পরে। এছাড়া মাটি থেকে গাছ অধিকতর পুষ্টি উপাদান গ্রহণ করে দিন দিন মাটির উর্বরতা নষ্ট করে।

উদ্ভাবিত মোবাইল অ্যাপটির কার্যকারিতা সম্পর্কে তিনি বলেন, আমাদের অ্যাপটি বাংলা এবং ইংরেজি দুই ভাষাতেই ব্যবহার করা যাবে। পরে জেলা, উপজেলা এবং ইউনিয়ন নির্বাচন করে কোন ফসলের জন্যে কোন সার কতটুকু লাগবে সেটির মোট পরিমাণ করার জন্য বৃষ্টিপাত, মাটির গুণাগুণ ও কাঙ্ক্ষিত ফলনের পরিমাণ উল্লেখ করতে হবে।

পাশাপাশি জৈব সার ব্যবহার করা হবে কি না এবং ফসলের কি পরিমাণ অবশিষ্টাংশ জমিতে থাকে এসব তথ্যও অ্যাপে দিতে হবে। এরপরেই কৃষকের দেয়া সকল তথ্য বিশ্লেষণ করে যতটুকু সার দেয়া হয়েছে তার একটি ব্যালেন্স মান দেবে অ্যাপ। ব্যালেন্সের মান ঋণাত্মক আসলে বুঝতে হবে ওই পরিমাণ অতিরিক্ত সার জমিতে দিতে হবে। আর যদি ধনাত্মক মান আসে তাহলে ওই পরিমাণ সার অতিরিক্ত দেয়া হয়েছে। সেক্ষেত্রে পরবর্তী সময়ে ওই পরিমাণ সার কম প্রয়োগ করতে হবে। এতে যেমন খরচ কমবে পাশাপাশি উৎপাদনও বৃদ্ধি পাবে।

তিনি জানান, সারের হিসেব করে এমন অনেক অ্যাপ রয়েছে। কিন্তু অন্য অ্যাপের সঙ্গে আমাদের তৈরি অ্যাপের বিশেষ পার্থক্য রয়েছে। সারের হিসেব দেয়ার পাশাপাশি এই অ্যাপ আরও জানাবে কতটুকু সার গাছ গ্রহণ করলো, কতটুকু সার ভূগর্ভস্থ ও নদীর পানিতে অপচয় হলো, কতটুকু সার বায়ু দূষণে যুক্ত হলো (যেমন-অ্যামোনিয়া গ্যাস) এবং কতটুকু সার গ্রিন হাউজ গ্যাস তৈরি করলো (যেমন-নাইট্রাস অক্সাইড)।

অ্যাপের কার্যকারিতায় টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের ব্যাপারে তিনি বলেন, খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা বিশ্বব্যাপী একটি প্রধান উদ্বেগের বিষয় এবং বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়।

টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার (এসডিজি) সতেরোটি লক্ষ্যের মধ্যে চারটি (এসডিজি লক্ষ্যমাত্রা-২, ৬, ১৩ এবং ১৫) মাটির উর্বরতা ব্যবস্থাপনার উপর গুরুত্বারোপ করে। লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী প্রধান ফসলের সফল চাষের জন্য সর্বোত্তম মাটির পুষ্টির ভারসাম্য নিশ্চিত করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশে সারের ব্যবহার ২০০২ সালে প্রতি হেক্টরে ১৮৮.৬ কেজি ছিলো।

২০১৬ সালে যা প্রতি হেক্টরে ২৮৯.৪ কেজি হয়েছে। বার্ষিক প্রায় ৩ দশমিক ৫২ শতাংশ হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে সারের ব্যবহার। ২০১৮ থেকে ১৯ সালে দেশে সাড়ে পাঁচ মিলিয়ন মেট্রিক টন সার ব্যবহার করা হয়েছে, যার মধ্যে শুধু ইউরিয়ার পরিমাণ ছিলো ২ দশমিক ৫৫ মিলিয়ন মেট্রিক টন।

সরকার সারের উপর যথেষ্ট ভর্তুকি (বার্ষিক প্রায় ত্রিশ হাজার কোটি টাকা) প্রদান করে ক্ষুদ্র কৃষকদের সমর্থন করার জন্য সক্রিয় পদক্ষেপ নিয়েছে। রাসায়নিক সারের অত্যধিক ব্যবহার দীর্ঘমেয়াদে মাটির পুষ্টির পাশাপাশি পরিবেশ দূষণ ব্যবস্থাপনার জন্য একটি উল্লেখযোগ্য চ্যালেঞ্জ তৈরি করে। এই বিবেচনার আলোকে আমরা 'নিউট্রিয়েন্ট ব্যালেন্স' অ্যাপটি নিয়ে কাজ করছি। যা অতিরিক্ত সার ব্যবহার কমিয়ে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে সাহায্য করবে।

তিনি বলেন, এ পর্যন্ত দেশের তিনটি স্থানে (বগুড়ার শেরপুর, কুমিল্লার চান্দিনা, ময়মনসিংহের মুক্তাগাছা) এই অ্যাপ দিয়ে প্রাথমিক গবেষণা করা হয়েছে। যা তিনটি স্থানেই আশানুরূপ ফলাফল দিয়েছে। অ্যাপটির এখনো উন্নয়ন কার্যক্রম চলছে। এটি সম্পূর্ণ কৃষকবান্ধব করে কৃষক পর্যায়ে প্রচারণা করা হবে। আমাদের উদ্দেশ্য হলো দেশের সবগুলো জেলার কৃষকদের কাছে এই অ্যাপটি পৌঁছে দেয়া। বর্তমানে প্রযুক্তির এই যুগে আমাদের তৈরি এই অ্যাপটি স্মার্ট বাংলাদেশে স্মার্ট কৃষক তৈরিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলে আশা প্রকাশ করেন এই গবেষক।


পিএনএস/এমএইউ

@PNSNews24.com

আপনার মন্তব্য প্রকাশ করুন