কলিম শরাফী

  08-05-2015 01:54AM


পিএনএস ডেস্ক : বাংলাদেশের শিল্প-সংস্কৃতিতে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখা ব্যক্তিত্বদের অন্যতম কলিম শরাফী। এ রবীন্দ্রসঙ্গীতশিল্পী, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ১৯২৪ সালের এই দিনে (৮ মে) ব্রিটিশ ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বীরভূমের খয়রাদিহি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন৷
তার পুরো নাম মাখদুমজাদা শাহ সৈয়দ কলিম আহমেদ শরাফী। তার বাবার নাম সামি আহমেদ শরাফী ও মা আলিয়া বেগম। কলিম শরাফীর পড়ালেখায় হাতেখড়ি হয় আরবি ওস্তাদজী ও বাংলা পণ্ডিত মশাইয়ের হাতে। ১৯২৯ সালে পাঠশালায় ভর্তি হন। তাঁতিপাড়া প্রাইমারি স্কুলে তৃতীয় শ্রেণী পর্যনন্ত পড়ে কলকাতায় বাবার কাছে চলে যান। সেখানে ১৯৩৫ সালে মাদ্রাসা-ই-আলিয়াতে অ্যাংলো পার্সিয়ান বিভাগে চতুর্থ শ্রেণীতে ভর্তি হন।
শরাফী বিদ্যালয়ে পড়াকালে রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। তিনি যখন দশম শ্রেণীর শিক্ষার্থী তখন নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু কলকাতার ‘হলওয়েল মনুমেন্ট’ সরানোর আন্দোলন শুরু করেন। তিনি সে আন্দোলনে জড়িয়ে স্কুলের মিছিলের নেতৃত্ব দিতে গিয়ে পুলিশের হাতে নির্যাতিত হন। ১৯৪২ সালে তিনি ম্যাট্রিক পাস করেন। পরীক্ষার পরই গান্ধীর ‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলনে যুক্ত হন। ১৯৪২ সালে নিজ এলাকার এক সভায় সভাপতিত্ব করার কয়েকদিন পর ডিফেন্স অব ইন্ডিয়া অ্যাক্টের আওতায় গ্রেফতার হন। কারাগারেই বিভিন্ন শিল্পীর সঙ্গে পরিচয় হয়। মুক্তির পর বীরভূম জেলা ছাত্র ফেডারেশনের সেক্রেটারির দায়িত্ব নেন। পঞ্চাশের মন্বন্তরে লঙ্গরখানায় কাজ করার সময় কমিউনিস্ট নেতা কমরেড মুজাফফর আহমেদের সংস্পর্শে আসেন, যোগ দেন কমিউনিস্ট পার্টিতে।
১৯৪৫ সালে শরাফী ভর্তি হন হেতমপুর কৃষ্ণনাথ কলেজে। রাজনৈতিক কারণে কৃষ্ণনাথ কলেজ ছেড়ে ভর্তি হন ক্যাম্পবেল মেডিকেল স্কুলে। কিন্তু অর্থনৈতিক কারণেই পড়াশোনার পাঠ চুকিয়ে ফেলতে হয়। ১৯৪৬ সালে সিটি কলেজে বাণিজ্য বিভাগে ভর্তি হন। ১৯৪৬ সালে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সময় ইন্ডিয়ান পিপলস থিয়েটার অ্যাসোসিয়েশনের হয়ে বর্ডার গার্ডের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৪৮ সালে তিনি আবারও গ্রেফতার হন। তবে জিজ্ঞাসাবাদের পর ছেড়ে দেওয়া হয়।
কলিম শরাফীর সঙ্গীতজীবন ছিল বৈচিত্র্যময়। ১৯৪৪ সালে তিনি ইন্ডিয়ান পিপলস থিয়েটার অ্যাসোসিয়েশনে (আইপিটিএ) যোগ দিয়ে কলকাতার হাজারা পার্কে হাজার হাজার শ্রোতার উপস্থিতিতে সর্বপ্রথম গণসঙ্গীত পরিবেশন করেন। ১৯৪৬ সালে এইচএমভি থেকে বের হয় তার প্রথম গণসঙ্গীতের রেকর্ড। সে সময় কলকাতা বেতারে নিয়মিত শিল্পী হিসেবে তালিকাভুক্ত হন। কলিম শরাফী কলকাতায় শুভ গুহঠাকুরতার বিখ্যাত সঙ্গীত বিদ্যালয় ‘দক্ষিণী’ থেকে ১৯৪৬ থেকে ১৯৫০ সাল পর্যন্ত তালিম নেন। পরে সেখানে শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। ১৯৪৮ সালে নীতিগত বিরোধের কারণে মনোরঞ্জন ভট্টাচার্য, শম্ভু মিত্র, তৃপ্তি মিত্র, অশোক মজুমদার, মোহাম্মদ ইসরাইল, কলিম শরাফী প্রমুখ আইপিটিএ থেকে বেরিয়ে এসে গঠন করেন নাট্যসংস্থা ‘বহুরূপী’।
দেশ বিভাগের পর কলিম শরাফী ১৯৫০ সালে ঢাকায় চলে আসেন। এখানে ক্যাজুয়াল আর্টিস্ট হিসেবে যোগ দেন রেডিওতে। ১৯৫১ সালে ঢাকা ছেড়ে চলে যান চট্টগ্রামে। গড়ে তোলেন ‘প্রান্তিক’ নামে একটি সংগঠন। ১৯৫৬ সালে শেরেবাংলার মন্ত্রিসভাকে বরখাস্ত করে সেকশন নাইনটি টু জারি করার ফলে কলিম শরাফীকে আত্মগোপন করতে হয়। সে বছরের শেষদিকে আবার ঢাকায় ফিরে ‘হ-য-ব-র-ল’ নামে সংগঠন গড়ে তোলেন। এর ব্যানারেই মঞ্চস্থ করেন ‘তাসের দেশ’। সে সময় তার সহযোগী ছিলেন ড. আনিসুর রহমান ও ড. রফিকুল ইসলাম।
১৯৫৮ সালে রেডিওতে তার গান সম্প্রচার নিষিদ্ধ হয়। ১৯৬৪ থেকে ৬৭ সাল পর্যন্ত পাকিস্তান টেলিভিশনে অনুষ্ঠান পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৬৯ থেকে ৭২ সাল পর্যন্ত পাকিস্তান গ্রামোফোন কোম্পানির পরিচালক ও জেনারেল ম্যানেজার হিসেবে কর্মরত ছিলেন। ১৯৭৪ থেকে ৭৬ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস করপোরেশনের চিফ ইনফরমেশন অফিসার ও জেনারেল ম্যানেজার পদে দায়িত্ব পালন করেন।
১৯৫৭ সালে তিনি প্রথমবারের মতো ‘আকাশ আর মাটি’ চলচ্চিত্রে রবীন্দ্রসঙ্গীত পরিবেশন করেন। ১৯৬০ সালে সোনার কাজল চলচ্চিত্রে প্রযোজকের দায়িত্ব পালন করেন। সে সময় তার সঙ্গীত পরিচালনায় নির্মিত প্রামাণ্যচিত্র ‘ভেনিস’ আন্তর্জাতিক পুরস্কার অর্জন করে। এর পর ‘সূর্যস্নান’ ছবিতে ‘পথে পথে দিলাম ছড়াইয়া রে’ গানটি গেয়ে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পান। এ ছাড়া কবিয়াল রমেশ শীলের জীবন নিয়ে একটি তথ্যচিত্রও নির্মাণ করেন। তিনি একাধিক চলচ্চিত্রে কণ্ঠ দিয়েছেন৷ কলিম শরাফীর ৫টি অ্যালবাম প্রকাশিত হয়েছে— এই কথাটি মনে রেখো, আমি যখন তার দুয়ারে, কলিম শরাফীর যত গান, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গান এবং জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্রের কথা ও সুরে নবজীবনের গান। ‘স্মৃতি অমৃত’ তার প্রকাশিত গ্রন্থ৷
কলিম শরাফী ১৯৬৯ সালে সত্যেন সেনের সঙ্গে উদীচীর কর্মকাণ্ডে যোগ দেন। ১৯৭৯ সালে গঠিত ‘জাহিদুর রহিম স্মৃতি পরিষদ’-এর প্রতিষ্ঠাতা আহ্বায়ক ছিলেন কলিম শরাফী। এরপরে এ সংগঠনটি ‘জাতীয় রবীন্দ্রসঙ্গীত সম্মিলন পরিষদ’-এ পরিণত হয়। কলিম শরাফী ১৯৮৩ সালের এপ্রিলে ‘সঙ্গীতভবন’ নামে একটি সঙ্গীত বিদ্যালয় গড়ে তোলেন। প্রতিষ্ঠাকাল থেকেই তিনি এর অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করেন। তিনি শিল্পকলা একাডেমী পরিষদ ও শিশু একাডেমী পরিষদের সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এছাড়া বাংলাদেশ বেতার ও টেলিভিশন শিল্পীসংস্থা, বাংলাদেশ রবীন্দ্রসঙ্গীতশিল্পী সংস্থা এবং নাগরিক নাট্যাঙ্গনের সভাপতি ছিলেন।
১৯৯০ এর দশকে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে শিল্পী-সংস্কৃতিকর্মীদের সংগঠিত করার কাজ করেন কলিম শরাফী। যুদ্ধাপরাধের বিচারের দাবিতে গণআদালতে সম্পৃক্ত হওয়ায় ১৯৯১ সালে রাষ্ট্রদ্রোহিতার মামলায় তাকে আসামি করা হয়।
কলিম শরাফী অনেক পুরস্কার ও সম্মাননায় ভূষিত হন। উল্লেখযোগ্য হলো- একুশে পদক (১৯৮৫), স্বাধীনতা দিবস পুরস্কার (১৯৯৯), নাসিরউদ্দিন স্বর্ণপদক (১৯৮৮), বেগম জেবুন্নেছা ও কাজী মাহবুব উল্লাহ স্বর্ণপদক (১৯৮৭), সত্যজিত রায় পুরস্কার (১৯৯৫) এবং শিক্ষা ও সংস্কৃতি চর্চা কেন্দ্র থেকে ‘কৃতী বাঙালি সম্মাননা পদক’ (১৯৮৮)। এছাড়া বাংলা একাডেমি ফেলোশিপ, রবীন্দ্র সুবর্ণজয়ন্তী পাটনা, কলকাতার শিল্পমেলার বঙ্গ সংস্কৃতি, বুলবুল ললিতকলা একাডেমি, সিকোয়েন্স অ্যাওয়ার্ড অব অনার, রাষ্ট্রপতি আবু সাঈদ চৌধুরী অ্যাওয়ার্ড, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় গুণীজন সংবর্ধনা, পশ্চিমবঙ্গের রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ১২৫তম জন্মবার্ষিকী, ডি-৮ আর্ট অ্যান্ড কালচার ফেস্টিভ্যাল, পাকিস্তান ইত্যাদি অনুষ্ঠানে সম্মানিত হন। সর্বশেষ তিনি বাংলা একাডেমি প্রবর্তিত ‘রবীন্দ্র পুরস্কার ২০১০’-এ ভূষিত হন।
কলিম শরাফী ১৯৪৯ সালে প্রথম বিয়ে করেন। প্রথম স্ত্রীর সঙ্গে ১৯৫৭ সালে বিচ্ছেদের পর ১৯৬৩ সালে আবার বিয়ে করেন। তার দ্বিতীয় স্ত্রী অধ্যাপিকা নওশেবা খাতুন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগে অধ্যাপনা করতেন। কলিম শরাফীর দুই সন্তানের নাম আলেয়া শরাফী ও আজিজ শরাফী। ২০১০ সালের ২ নভেম্বর ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন রবীন্দ্রসঙ্গীতের এই কিংবদন্তী শিল্পী। সূত্র : উইকিপিডিয়া

পিএনএস/আনোয়ার

@PNSNews24.com

আপনার মন্তব্য প্রকাশ করুন