প্রযুক্তির ক্যান্সার হিসেবে আতঙ্ক পর্নো সাইট!

  26-02-2024 11:03AM



পিএনএস ডেস্ক: প্রযুক্তির ক্যান্সার হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে পর্নো সাইট বা নিষিদ্ধ নীল ছবি। ইন্টারনেটের ডাটা থাকলেই হাতের মুঠোয় পাওয়া যাচ্ছে লাখ লাখ পর্নো সাইট। শিশু-কিশোর থেকে শুরু করে সব বয়সী মানুষের কাছে সহজলভ্য হয়ে উঠেছে এসব সাইটে থাকা নানা কিসিমের পর্নো ভিডিও। তবে সবচেয়ে আতঙ্কের বিষয় অপ্রাপ্ত বয়স্ক কিশোররা এতে আসক্ত হয়ে পড়ছে।

বিভিন্ন জরিপে এ নিয়ে ভয়াবহ তথ্য উঠে আসছে। পর্নোগ্রাফিতে আসক্ত হয়ে অনেকে মানসিক ভারসাম্য হারাচ্ছেন। বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি) বিষয়টি নিয়ে অনেকটা ব্যর্থ হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। সংশ্লিষ্টরা জানান, ১৪ বছর আগে পর্নো সাইটের দৌরাত্ম্য প্রথম নজরে আসে। তখন ইন্টারনেট প্রসার না থাকায় সমস্যাটা প্রকট হয়নি। কিন্তু এরমধ্যে ইন্টারনেট হয়ে গেছে মানুষের মৌলিক অধিকারের মতো একটি।


এই সুযোগে হাতে হাতে পৌঁছে গেছে পর্নো সাইট। তাই বিষয়টি নিয়ে বিপাকে পড়েছে বিটিআরসি। তাদের তথ্য মতে লাখ লাখ পর্নো সাইট সক্রিয় রয়েছে। গত ১৪ বছরে এ পর্যন্ত ২৬ হাজারের বেশি পর্নো সাইট বন্ধ করতে পেরেছে বিটিআরসি। কিন্তু প্রতিদিনই নতুন নতুন সাইট যোগ হচ্ছে ইন্টারনেট মাধ্যমে। প্রযুক্তিবিদরা বিষয়টিকে আতঙ্কজনক হিসেবে চিহ্নিত করছেন। তাদের ভাষায়, প্রযুক্তি দিয়ে এই ক্যান্সার থেকে পুরোপুরি রক্ষা পাওয়া সম্ভব নয়।

বিটিআরসি’র হিসাব মতে, চলতি বছরের জানুয়ারি পর্যন্ত মোট মোবাইল গ্রাহক সংখ্যা ১৯০ দশমিক ৪৬ মিলিয়ন। আর ইন্টারনেট গ্রাহক রয়েছে ১২৯ দশমিক ১৮ মিলিয়ন। এর মধ্যে মোবাইল হ্যান্ডসেটে ইন্টারনেট ব্যবহারকারী রয়েছে ১১৬ দশমিক ৩০ মিলিয়ন এবং আইএএসপি ও পিএসটিএন-এর মাধ্যমে গ্রাহক রয়েছে ১২ দশমিক ৮৮ মিলিয়ন। বলা যায়, সব মাধ্যমের ইন্টারনেট থেকেই পর্নো সাইটগুলোতে ঢুঁ- মারছেন ব্যবহারকারীরা।

এ প্রসঙ্গে বাংলালিংকের করপোরেট ও রেগুলেটরি অ্যাফেয়ার্স বিভাগের প্রধান তাইমুর রহমান বলেন, আমরা গ্রাহকদের কাছে ডেটা বিক্রি করি। ওই ডেটা দিয়ে একজন গ্রাহক কী ধরনের কাজ করেন তা আমাদের রেকর্ডে থাকে না। তবে পর্নো সাইটগুলো দেখতে বেশির ভাগ গ্রাহক ভিপিএন ব্যবহার করে থাকেন। দেশে পর্নো ওয়েবসাইট বন্ধে একাধিকবার উদ্যোগ নেয়া হলেও এসব সাইট পুরোপুরি ব্লক করা সম্ভব হয়নি। কিছুদিনের জন্য বন্ধ করা গেলেও পরবর্তীতে সাইটগুলো সচল হয়ে যায়। গত ৮ বছর ধরে সরকারের একটি মন্ত্রণালয় সক্রিয়ভাবে উদ্যোগ নিয়েও পর্নো সাইট বন্ধ করতে পারেনি। তবে পর্নো সাইটের দৌরাত্ম্য বন্ধে বিটিআরসি’র ব্যর্থতা দেখছে বাংলাদেশ মুঠোফোন গ্রাহক এসোসিয়েশন।

সংগঠনটির সভাপতি মহিউদ্দিন আহমেদ বলেন, আমরা অন্য সাইট বন্ধের দাবি জানানোর পর এবং মানবজমিন-সহ বেশ কিছু গণমাধ্যম গুরুত্বের সঙ্গে পর্নোগ্রাফি নিয়ে সংবাদ পরিবেশনের পর সাবেক ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার ঘোষণা দিয়েছিলেন পর্নোগ্রাফি সকল লিংক বন্ধ করে দেয়া হবে। দেশের ৯৭ ভাগ মুসলিম জনগোষ্ঠীর দেশে কোনোভাবেই পর্নোগ্রাফি ইন্টারনেটে সয়লাব হতে দেয়া যায় না। কিছু লিংক সে সময় বন্ধ করে দেয়া গেলেও এখনো ফ্রি ফায়ার, ভিপিএন, এমনকি গুগলের ক্রমোব্রাউজ করলেই খুব সহজেই মিলে যাচ্ছে পর্নোগ্রাফি। এসব মাধ্যমে সচরাচর প্রাপ্ত ও শিশু- কিশোর সকলেই ব্রাউজ করলেই দেখতে পাচ্ছেন পর্নোগ্রাফি। অথচ আমাদের নিয়ন্ত্রক সংস্থা নীরব ভূমিকা পালন করছে এব্যাপারে।

তিনি বলেন, সবচাইতে ভয়ানক ব্যাপার হচ্ছে এই পর্নোগ্রাফিগুলোতে ব্যাপক বিজ্ঞাপন প্রচার হচ্ছে। আর এসব বিজ্ঞাপনের বেশির ভাগ লিংকে ফিশিং রয়েছে এবং প্রতারকদের প্রধান প্রতারণার উৎস কেন্দ্র হয়ে দাঁড়িয়েছে এই পর্নোগ্রাফি সাইট। এ ছাড়া জুয়ার সকল সাইট এই পর্নোগ্রাফির লিংকগুলোতে বিজ্ঞাপন দিয়ে যাচ্ছে। মূলত যত প্রকার জুয়া খেলা হয় তার সকল লিংক পাওয়া যায় পর্নোগ্রাফিতে। প্রতারক চক্র এখানে সক্রিয়। যখন কোনো প্রাপ্ত-অপ্রাপ্ত ব্যক্তি পর্নোগ্রাফি লিংকে প্রবেশ করছে সঙ্গে সঙ্গে প্রতারক চক্র তাকে বিভিন্ন ফিশিং, জুয়া খেলার অফার, কিংবা সরাসরি ভিডিও কলের মাধ্যমে অসামাজিক কাজে লিপ্ত হওয়ার প্রলোভন দিয়ে থাকে। এ ধরনের লোভনীয় প্রস্তাবে যখন কোনো ব্যক্তি বা গ্রাহক সাড়া দিচ্ছে ঠিক তখনই সে সর্বস্বান্ত হয়ে যাচ্ছে। এমনকি তার ব্যক্তিগত তথ্যও হাতিয়ে নিচ্ছে প্রতারক চক্র। অনেক সময় ব্ল্যাকমেইল করার জন্য তারা ভিডিও চ্যাটিং ব্যবহার করছে।

মহিউদ্দীন আহমেদ বলেন, অনেক ব্যক্তি মান-সম্মানের ভয়ে হয়তো মামলা বা তার এই প্রতারণার কথা স্বীকার করতে চায় না। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে পর্নোগ্রাফিতে সর্বস্বান্ত হচ্ছে দেশের লাখ লাখ মানুষ। অন্যদিকে ধর্মীয় চেতনা বিনষ্ট হচ্ছে। নিয়ন্ত্রক সংস্থা সবকিছু জেনে বুঝেও কেন এসব লিংক বন্ধ করতে পারছে না তা আমাদের কাছে বোধগম্য নয়। আমরা মনে করি নিয়ন্ত্রণ সংস্থার উদাসীনতা এবং ব্যর্থতাই অন্যতম কারণ।

একই প্রসঙ্গে তথ্য প্রযুক্তিবিদ সুমন আহমেদ সাবির বলেন, প্রযুক্তির সাইট থেকে পর্নোসাইট একেবারে বন্ধ করা সম্ভব নয়। এ পর্যন্ত যেসব সাইট বন্ধ করা হয়েছে সেগুলো হয়তো সাময়িকভাবে এক্সেস করা সম্ভব হয় না। কিন্তু আরও অনেক বিকল্প ব্যবস্থা আছে যেগুলো দিয়ে সেসব সাইট ব্যবহার করা যায়। ইন্টারনেট এখন এমন অবস্থা হয়েছে যে, আপনি চাইলেই যেকোনো ধরনের কনটেন্ট বন্ধ করতে পারবেন না। আসলে প্রযুক্তি দিয়ে ইন্টারনেট কনটেন্ট বন্ধ করা সম্ভব না। বরং বন্ধ করার চেষ্টা করলে মানুষের আগ্রহ আরও বাড়ে। আসলে মূল জিনিস হলো, আমাদের পারিবারিক, সামাজিক মূল্যবোধ এবং আমাদের সন্তানদের নানা ধরনের কাজে এনগেজ করতে পারলে তারা এসবে সময় কম দিতো। স্কুল থেকে এ নিয়ে শিক্ষা দেয়া যেতে পারে।

এক প্রশ্নে তিনি জানান, ছোট পরিসরে যেমন বাসা, হোটেল, অফিসের মতো ছোট পরিসরে পর্নো সাইট নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। যেমন সবার আগে এ ধরনের উদ্যোগ নিয়েছে সিঙ্গাপুর। ১৯৯৮ সালে তারা পর্নোসাইট নিয়ন্ত্রণের উদ্যোগ নেয়। কারণ তারা তখনই বুঝে গিয়েছিল এর ক্ষতিকারক দিকগুলো। তারপরও বলবো আমাদের সংশ্লিষ্টরা যদি বিষয়টি নিয়ে চেষ্টা ও উদ্যোগ নেয় তাহলে ভালো ফলাফল পেতে পারে।

২০১০ সালের শুরুর দিকে প্রথমবারের মতো বাংলাদেশের সামাজিক মূল্যবোধের পরিপন্থি হিসেবে চিহ্নিত করে ৮৪টি পর্নো ওয়েবসাইট বন্ধ করে দেয়ার জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে চিঠি দেয় পুলিশ সদর দপ্তর। চিঠিতে ওই ওয়েবসাইটগুলোকে অশ্লীল ও বিকৃত উল্লেখ করে বিটিআরসি’র মাধ্যমে সেগুলো বন্ধ করে দেয়ার আবেদন জানানো হয়। সাইটগুলোর তালিকা দিয়ে চিঠিতে বলা হয়, ‘ওই সাইটগুলোতে কিছুদিন ধরে দেশের মানুষের গোপনে ধারণ করা যৌনতার ছবি ও ভিডিও প্রদর্শন করা হচ্ছে।’

অন্যদিকে, এর আগে এক আন্তঃমন্ত্রণালয় সভায় এগুলো বন্ধ করার সিদ্ধান্ত হয়। এ ধরনের আরও ওয়েবসাইট খুঁজে বের করে ব্যবস্থা নেয়ার লক্ষ্যে একটি কমিটি গঠনের জন্যও বিটিআরসিকে নির্দেশনা দেয়া হয়। বিটিআরসি উদ্যোগ নিলে দুই সপ্তাহের মতো বন্ধ ছিল পর্নো সাইটগুলো। পরে ২০১১ সালের জানুয়ারি মাসের শেষ সপ্তাহ থেকে আবারো সক্রিয় হতে থাকে পর্নো সাইটগুলো। পর্নো সাইট বন্ধ করতে না পারার পেছনে প্রযুক্তিগত সক্ষমতার অভাবও একটি বড় কারণ বলে জানিয়েছেন প্রযুক্তিবিদরা। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পর্নো সাইট কারিগরিভাবে শতভাগ বন্ধ করা সম্ভব নয়। তবে ৯০ ভাগ বন্ধ করা সম্ভব। শতভাগ বন্ধের চেষ্টা করাও উচিত নয়। তাহলে সে চেষ্টাও ব্যর্থ হতে পারে।

এর আগে সাবেক ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার গণমাধ্যমকে বলেন, মূল বিষয়টি হলো আমাদের যদি পর্নোগ্রাফি সাইট থাকতো তাহলে তা বন্ধ করা যেত বা বা সম্ভব হতো। কিন্তু সমস্যা হলো ইউটিউবে। এখন পর্নোগ্রাফির বড় সোর্স হলো ইউটিউব। ইউটিউবে বন্ধ করা কঠিন। ইউটিউবের এ ধরনের কনটেন্ট আমাদের কমিউনিটি স্ট্যান্ডার্ডের সঙ্গে যায় না।

আমরা ফেসবুকের সঙ্গে যেমন আইস ব্রেকিংয়ের জায়গায় যেতে পেরেছি, ওদের যেমন কোনো কিছু শুনতে বা করতে বাধ্য করতে পেরেছি তেমনি ইউটিউবের সঙ্গে করতে পারলে পর্নোগ্রাফিও নিয়ন্ত্রণে আনতে পারবো। ২০১৬ সালের ডিসেম্বর মাসে সরকার দেশে ৫৬০টি পর্নো সাইট বন্ধের নির্দেশ দেয়। এই ঘোষণা সে সময় দ্রুত কার্যকর করে সংশ্লিষ্টরা। ওই সময় ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগের সচিব ফয়জুর রহমান চৌধুরী বরাবর পর্নো ওয়েবসাইট বন্ধের আহ্বান জানিয়ে চিঠি দেন এক অভিভাবক।

তিনি চিঠিতে অসহায়ত্ব প্রকাশ করে লিখেছিলেন, এসব সাইট বন্ধ করা না হলে সমাজের কোমলমতি শিশু-কিশোররা ধ্বংস হয়ে যাবে। সমাজ পতিত হবে এক ভয়ঙ্কর আসক্তিতে। এখনই পর্নো সাইটগুলো বন্ধ করা না গেলে তা আগামী দিনে ভয়ঙ্কর পরিণাম ডেকে আনবে। তিনি চিঠিতে আরও উল্লেখ করেন, সমাজের অনেক সন্তান এরইমধ্যে এসবে আসক্ত হয়ে গেছে।

এ প্রসঙ্গে বিটিআরসি’র উপ-পরিচালক (মিডিয়া কমিউনিকেশন অ্যান্ড পাবলিকেশন) জাকির হোসেন খান বলেন, প্রতিনিয়ত আমরা পর্নোসাইট বন্ধে কাজ করছি। পাশাপাশি সামাজিক ও পারিবারিক সচেতনতা বাড়াতে উৎসাহিত করছি।


পিএনএস/এমএইউ

@PNSNews24.com

আপনার মন্তব্য প্রকাশ করুন