আয়ানের মৃত্যু, ‘তদন্ত কমিটির ৩ জন একই মেডিকেলের, যা সন্দেহজনক’

  05-03-2024 12:56PM



পিএনএস ডেস্ক: রাজধানীর সাতারকুল বাড্ডার ইউনাইটেড মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে সুন্নতে খৎনার জন্য অজ্ঞান করা শিশু আয়ান আহমেদের মৃত্যুর ঘটনায় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের গঠিত তদন্ত কমিটি অনুমানের ভিত্তিতে রিপোর্ট দিয়েছেন বলে মন্তব্য করেছেন হাইকোর্ট।

আদালত লিখিত আদেশে বলেছেন, দেশে অনেক দক্ষ চিকিৎসক আছেন। কিন্তু স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তদন্ত কমিটির ৪ জনের মধ্যে ৩ জন একই মেডিকেল কলেজের(মুগদা মেডিকেল) যা সন্দেহজনক। শিশু আয়ানের মৃত্যুর ঘটনা তদন্তে নতুন কমিটি গঠনের লিখিত আদেশে বিচারপতি মোস্তফা জামান ইসলাম ও বিচারপতি মো. আতাবুল্লাহর হাইকোর্ট বেঞ্চ এ মন্তব্য করেছেন।

মঙ্গলবার (৫ মার্চ) প্রকাশিত ৪ পৃষ্ঠার লিখিত আদেশে আরও বলা হয়েছে, আমরা সতর্কতার সাথে উভয়পক্ষের যুক্তিতর্ক বিবেচনা করেছি এবং রেকর্ডে থাকা তথ্যগুলো পর্যালোচনা করেছি। এতে কোনো বিতর্ক নেই যে শিশু আয়ানকে শুধুমাত্র খৎনা অস্ত্রোপচারের উদ্দেশ্যে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল। অন্য কোন উদ্দেশ্যে নয়। এটাও বিতর্কিত নয় যে শিশু আয়ানের খৎনা করার আগেই অ্যানেস্থেশিয়ার পদ্ধতি অনুসরণ করার কারণে শারীরিক অবস্থার অবনতি হয়।

আদেশে বলা হয়, শিশু আয়ানের মৃত্যু নিয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের গঠিত চার সদস্যের কমিটি যে প্রতিবেদন দিয়েছে সেই প্রতিবেদনে শিশু আয়ানের মৃত্যুর কারণ সম্পর্কে কোনো ইতিবাচক মতামত দেয়নি। বরং শিশু আয়ান ব্রঙ্কিয়াল অ্যাজমা রোগে ভুগছিলেন বলে অনুমান করে রিপোর্ট দিয়েছে তদন্ত কমিটি। তাহলে আয়ানের কীভাবে মৃত্যু হল তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।

আদালতের কাছে মনে হয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের গঠিত তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন সন্তোষজনক নয়। আদেশে আরও বলা হয়, আমাদের দেশে আরও দক্ষ চিকিৎসক আছে বলে প্রতীয়মান হয়। কিন্তু তদন্ত কমিটির ৪ জনের মধ্যে ৩ জন একই মেডিকেল কলেজের যা সন্দেহজনক। আমাদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় স্বচ্ছতা এবং উন্নতি নিশ্চিত করার জন্য একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা অপরিহার্য। এ কারণে আমরা নতুন করে ৫ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করে দিচ্ছি। তারা এক মাসের মধ্যে আদালতে নতুন তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করবে।

তদন্ত কমিটির প্রধান হলেন, শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের অধ্যক্ষ ও অ্যানেস্থেসিওলজি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক এ.বি.এম. মাকসুদুল আলম। কমিটির সদস্যরা হলেন, বিএসএমএমইউর পেডিয়াট্রিক সার্জারি বিভাগের অধ্যাপক অধ্যাপক সুশঙ্কর কুমার মন্ডল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক হাফিজুর রহমান, ঢাকা শিশু হাসপাতালের পেডিয়াট্রিক সার্জারির অধ্যাপক ডাঃ আমিনুর রশীদ ও ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর প্রিভেন্টিভ অ্যান্ড সোশ্যাল মেডিসিনের (নিপসন), সহযোগী অধ্যাপক ডাঃ সাথী দস্তিদার।

এই কমিটি শিশু আয়ানের মৃত্যুর ঘটনাটি পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে তদন্ত করবে। এছাড়া শিশু আয়ানের চিকিৎসায় চিকিৎসকদের অবহেলা ঘটেছে কিনা তা খুঁজে বের করবে ও দায়ীদের চিহ্নিত করবে এবং এ ধরণের ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধে পদক্ষেপের সুপারিশ করবে।

তদন্ত কমিটিকে এই আদেশ প্রাপ্তির ১ মাসের মধ্যে বিষয়টি তদন্ত করে আদালতে প্রতিবেদন দাখিলের জন্য অনুরোধ করা হয়েছে। আদালত প্রত্যাশা করি কমিটি তদন্ত কমিটির সবাই অত্যন্ত নিষ্ঠার সাথে নিরপেক্ষভাবে দায়িত্ব পালন করবেন।

এর আগে গত ২০ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর সাতারকুল বাড্ডার ইউনাইটেড মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে সুন্নতে খৎনার জন্য অজ্ঞান করা শিশু আয়ান আহমেদের মৃত্যুর ঘটনা তদন্তে নতুন কমিটি গঠন করে দেন হাইকোর্ট। শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের অধ্যক্ষ ও অ্যানেস্থেসিওলজি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডাক্তার এ বি এম মাকসুদুল আলমকে কমিটির চেয়ারম্যান করা হয়।

আদালত বলেছেন, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কমিটির রিপোর্ট আমাদের মনঃপূত হয়নি। আমরা পাঁচ সদস্যের নতুন কমিটি করে দিচ্ছি। সেদিন আদালতে রাষ্ট্রপক্ষে শুনানি করেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল তুষার কান্তি রায়। সঙ্গে ছিলেন সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল সেলিম আজাদ। রিটের পক্ষে ছিলেন অ্যাডভোকেট এ বি এম শাহজাহান আকন্দ মাসুম। ইউনাইটেড হাসপাতালের পক্ষে শুনানি করেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী সাঈদ আহমেদ রাজা।

গত ২৯ জানুয়ারি সুন্নতে খৎনা করাতে গিয়ে রাজধানীর বাড্ডার ইউনাইটেড মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে শিশু আয়ান আহমেদের মৃত্যুর ঘটনায় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তদন্ত কমিটির রিপোর্ট লোক দেখানো (আইওয়াশ) ও হাস্যকর বলে মন্তব্য করেন হাইকোর্ট।

আদালত বলেন, দায় এড়ানোর জন্যই তারা (স্বাস্থ্য অধিদপ্তর) এ ধরনের রিপোর্ট দাখিল করেছে। শিশু আয়ানের অ্যাজমা সমস্যা থাকার কথা জানার পরও কেন চিকিৎসকরা অপারেশনের জন্য এত তাড়াহুড়া করলেন? শিশু আয়ানের সুন্নতে খৎনা করার সময় যে পরিমাণ ওষুধ ব্যবহার করা হয়েছে, হার্টের বাইপাসেও এত ওষুধ লাগে না বলে মন্তব্য করেন আদালত।

শিশু আয়ানের মৃত্যুর পর পত্রিকায় আসা খবরের ভিত্তিতে অভিযোগ তদন্তে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর একটি কমিটি গঠন করে। তদন্তে যেসব বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে সেগুলো হলো—আয়ানের বাবা শামীম আহমেদের লিখিত ও মৌখিক বক্তব্য, বাড্ডায় আয়ানের খতনা করার সাথে সংশ্লিষ্ট সকলের লিখিত ও মৌখিক বক্তব্য, গুলশানে আয়ানের চিকিৎসার সাথে সংশ্লিষ্ট সকলের লিখিত ও মৌখিক বক্তব্য নেওয়া হয়।

ঘটনার প্রেক্ষাপট সম্পর্কে প্রতিবেদনে বলা হয়, গত ৩১ ডিসেম্বর সাঁতারকুল বাড্ডার ইউনাইটেড মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে সুন্নতে খতনা করাতে আয়ানের বাবা নিয়ে আসেন এবং সুন্নতে খতনা করান। সুন্নতে খতনা করানোর পর আয়ানের শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে ওইদিনই ইউনাইটেড হাসপাতাল লিমিটেড, গুলশান-২ এ প্রেরণ করেন। পরবর্তীতে গত ৭ জানুয়ারি গুলশান-২ ইউনাইটেড হাসপাতালে চিকিৎসারত অবস্থায় মৃত্যুবরণ করে আয়ান। ৮ জানুয়ারি স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের স্মারকমূলে ৪ সদস্য বিশিষ্ট একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে ৭ (সাত) কর্মদিবসের মধ্যে মতামতসহ প্রতিবেদন দাখিল করার জন্য নির্দেশ দেয়।

প্রতিবেদনের মতামত অংশে চিকিৎসা ও ওষুধ সংক্রান্ত কিছু বিষয় উল্লেখ করা হয়েছে। আর শেষাংশে বলা হয়, ‘সুন্নতে খতনা অপারেশনে স্বাভাবিক রক্তপাত হয়েছে বলিয়া ধারণা হয়। ’

আর সুপারিশ অংশে বলা হয়—
১) হাসপাতালে একাধিক অ্যানেসথেসিওলজিস্ট নিয়োগ দেয়া।
২) রোগী ও রোগীর আত্মীয় স্বজনকে অ্যানেস্থেশিয়া ও অপারেশনের ঝুঁকিসমূহ ভালোভাবে অবহিত করা।
৩) হাসপাতালে আইসিইউ ব্যবস্থা রাখা।
৪) সরকারের অনুমোদনের পরে হাসপাতালের কার্যক্রম শুরু করা।

গত ৯ জানুয়ারি হাইকোর্টের সংশ্লিষ্ট শাখায় রিট আবেদনটি করেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী এ বি এম শাহজাহান আকন্দ মাসুম।

১৫ জানুয়ারি আইনজীবী শাহজাহান আকন্দ মাসুম জানিয়েছিলেন, সারা দেশে লাইসেন্স ও অনুমোদনহীন কতগুলো হাসপাতাল আছে, তার তালিকা এক মাসের মধ্যে আদালতে দাখিল করতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালককে (স্বাস্থ্যসেবা) নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট।

এছাড়া ১৫ বছরে চিকিৎসায় অবহেলার কারণে কতজনের মৃত্যু হয়েছে, সেই বিষয়ে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে তিন মাসের মধ্যে আদালতে প্রতিবেদন দিতেও বলা হয়েছে।

৩১ ডিসেম্বর সুন্নতে খতনা করানোর জন্য আয়ানকে সাঁতারকুল বাড্ডার ইউনাইটেড মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যান অভিভাবকরা। খতনা শেষ হওয়ার পর আয়ানের জ্ঞান না ফেরায় তাকে সেখান থেকে পাঠানো হয় গুলশান-২ এর ইউনাইটেড হাসপাতালে। সেখানে পিআইসিইউতে (শিশু নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র) লাইফ সাপোর্টে রাখা হয়। এর সাতদিন পর চিকিৎসকরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন।


পিএনএস/এমএইউ

@PNSNews24.com

আপনার মন্তব্য প্রকাশ করুন