পাহাড়ে নতুন সম্ভাবনা বারোমাসি তরমুজ

  13-12-2023 10:58AM




পিএনএস ডেস্ক: পাহাড়ি জেলা শেরপুরে ভিয়েতনামের গোল্ডেন ক্রাউন ও ব্ল্যাকবেবি জাতের বারোমাসি তরমুজ চাষ করে সফলতার মুখ দেখছেন কৃষক আমিনুল ইসলাম।

দেশি তরমুজের চাইতে এ জাতের তরমুজ খেতে সুস্বাদু ও পুষ্টিকর। তাই বাজারে খুচরা ও পাইকারি ব্যবসায়ীদের কাছে চাহিদাও ব্যাপক। অল্প পরিশ্রম ও স্বল্প বিনিয়োগে ফলন এবং দাম বেশি হওয়াতে লাভের মুখ দেখছেন এ উদ্যোক্তা। তার সফলতায় এলাকার অন্যান্য কৃষকও বারোমাসি হাইব্রিড তরমুজ চাষে আগ্রহী হয়ে উঠেছেন। স্থানীয় কৃষি বিভাগের আশা, জেলার বাণিজ্যিক সম্ভাবনার নতুন বার্তা বয়ে আনবে এই বারোমাসি তরমুজ।

সম্প্রতি পাহাড়ি জনপদ নলকূড়া ইউনিয়নের মানিককূড়া গ্রামের আমিনুল ইসলামের বাগানে গিয়ে দেখা যায়, স্বাস্থ্যসম্মত ও প্রাকৃতিক উপায়ে মালচিং পদ্ধতিতে সুগার কিং, ইয়েলো এবং ব্ল্যাক গোল্ড হাইব্রিড জাতের রঙিন তরমুজ চাষ করেছেন তরুণ এ কৃষি উদ্যোক্তা। তার বাগানে মাচার নিচে হলুদ, সবুজ ও কালো রঙ্গের তরমুজ শোভা পাচ্ছে। বোঁটা থেকে মাটিতে ছিঁড়ে না পড়ে এ কারণে তরমুজগুলো নেটের জালি দিয়ে বেঁধে রাখা হয়েছে। আর রাতে চুরির ভয়ে ক্ষেতে বিছানা পেতে পাহাড়া দিচ্ছেন তিনি। দূরদূরান্ত থেকে পাইকাররা আসছেন আজিজারের বাগানে। এদের সঙ্গে যোগ দিয়েছেন স্থানীয় কৃষক ও দর্শনার্থীরা।

আমিনুল ইসলাম বলেন, আমগোর পাহাড়ি এ এলাকায় ধানের পাশাপাশি দু চারজন কাকরুল, বরবটি ও চিচিঙ্গা আবাদ করে। এছাড়া অন্যকোনো মূল্যবান ফসল আবাদ কেউ করেনি। আমাগোর উপজেলা কৃষি অফিসের হুমায়ুন স্যার আমারে বীজ ও বিভিন্ন পরামর্শ দেন বারোমাসি তরমুজের ব্যপারে। স্যারের অনুপ্রেরণায় তরমুজ চাষে আগ্রহী হয়ে ১৩ শতাংশ জমিতে আবাদ শুরু করি।

তিনি জানান, তরমুজ চাষের আগে জমিতে গোবর, ডিএপি সার, পটাশ জিপসাম, পানি সেচ, বাঁশ, সুতা, বিষ ও লেবারসহ খরচ হয়েছে ২৫ হাজার টাকা। প্রতিটি মাচায় দুই থেকে সাড়ে তিন কেজি ওজনের তরমুজ ধরেছে। যার বর্তমান বাজার মূল্য কেজিপ্রতি পাইকারি ৮০ টাকা করে। এ পর্যন্ত ৬০ হাজার টাকার মতো বিক্রি করে ফেলেছেন। এখনো প্রচুর ফল বাগানে আছে। এতে সব খরচ বাদ দিয়ে ১ লাখ টাকার ওপরে আয় করতে পারবেন, আশা এ উদ্যোক্তার।

কৃষি তথ্য সার্ভিস (এআইএস) অনুযায়ী, তরমুজ সাধারণত এপ্রিল থেকে মে মাসে ওঠে। এটাই তরমুজের প্রধান মৌসুম, কিন্তু সম্প্রতি এ দেশের বাজারে এ সময় ছাড়া অন্য সময়েও তরমুজ পাওয়া যাচ্ছে।

অনেকে এর নাম দিয়েছেন ‘বারোমাসি তরমুজ’। গোল্ডেন ক্রাউন জাতের তরমুজের ওজন হয় এক থেকে দেড় কেজির মধ্যে আর ব্ল্যাকবেবি জাতের তরমুজ দেড় থেকে আড়াই কেজি হয়। তাই মাচায় ঝুলে থাকা ফলগুলো নেটের ব্যাগেই বেঁধে রাখতে হয়।

উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা হুমায়ুন দিলদার বলেন, বারোমাসি তরমুজ চাষাবাদের আগে জমির চারপাশের আইল থেকে ৫০ থেকে ৬০ সেন্টিমিটার চওড়া করে লম্বা বেড তৈরি করতে হবে। এরপর আরও ৬০ সেন্টিমিটার চওড়া একটি বেড তৈরি করতে হবে। এভাবে পাশাপাশি দুটো জোড়া বেড তৈরি করতে হবে। যার মধ্যে ৬০ সেন্টিমিটার খালি থাকবে।

এরপর জমিতে প্রয়োজনীয় সার ও গোবর দিয়ে মাটি ভালোভাবে আলগা করে নিতে হবে। তারপর মাটির আইল (ডারা) তৈরি করে এর ওপর পলিথিনজাতীয় মালচিং কাগজ বিছিয়ে দেওয়ার পর এক হাত পরপর ছিদ্র করে বীজ রোপণ করে দুই ফুট লম্বা উচ্চতায় মাচা (ঝাংলা) তৈরি করে দিতে হবে। বাঁশ ও নাইলন জাতীয় সুতা দিয়ে বানানো মাচায় গাছেএ ডগা তুলে দিতে হবে। প্রতি মাচায় গাছের ডালে প্রায় ২শর মতো তরমুজ ধরতে পারে।

বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য সাত্তার মন্ডল বলেন, ধান আমাদের প্রধান ফসল। কিন্তু বর্তমানে ধান আবাদে কৃষকদের তেমন একটা লাভ থাকে না। তাই অনেক কৃষক লাভজনক ফল উৎপাদনের দিকে ঝুঁকছেন। কৃষকরা ফল চাষের জন্য প্রতিটি সম্ভাব্য জায়গা ব্যবহার করছেন। গড়ে তুলেছেন বিভিন্ন দেশি-বিদেশি ফলের বাগান। আমাদের দেশের আবহাওয়া ও মাটি মাল্টা, স্ট্রবেরি ও ড্রাগন ফ্রুটের মতো বিদেশি ফল চাষের জন্যও অনুকূল।


জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক ড. সুকল্প দাস বলেন, শিক্ষিত তরুণরা কৃষি উদ্যোক্তায় ঝুঁকছেন। তারা অনেকেই তরমুজ উৎপাদনে সাফল্য পেয়েছেন এবং এটিই এবারের রেকর্ড উৎপাদনের মূল কারণ। প্রসঙ্গত, তরমুজ মূলত গ্রীষ্মকালীন ফল। যদিও এখন বারমাসি জাতের তরমুজ ক্রমশ জনপ্রিয় হচ্ছে। তবে বাজারে সাধারণত সবুজ রংয়ের ডোরাকাটা ও মসৃণ তরমুজ দেখা যায় যার ভেতরটা লাল- সেটিই বেশি দেখা যায়।

ড. সুকল্প দাস আরও বলেন, হাইব্রিডের মধ্যে হানিডিউ, ব্লাককুইন এবং বাংলালিংকসহ কয়েকটি জাতের চাষই এখন বেশি হচ্ছে। হলদু রঙয়ের তরমুজের মধ্যে সেরা জাতটির নাম হলো গোল্ডেন ক্রাউন। এছাড়া গোল্ডেন গ্লামার জাতের তরমুজটিও বাইরে হলুদ রঙয়ের কিন্তু ভেতরে লাল। ভারতের মহারাষ্ট্রের ৭০৭ জাতের তরমুজটির গায়ের রঙ কালো।

ভারতের আরেকটি জাত বাংলাদেশে জনপ্রিয় হচ্ছে সেটি হলো সাগর কিং। এর বাইরে তাইওয়ানের বিসুলা জাতের তরমুজটির খোসা পাতলা হয়। এটি বাইরে হলদু আর ভেতরে লাল হয়। তাইওয়ানেরই আরেকটি জাত বেশ সুস্বাদু যার নাম আনমল। এটি ভেতরে চিকচিকে হলুদ আর বাইরে সবুজ রঙয়ের হয়। যেহেতু অসময়ে পাওয়া যাচ্ছে তাই দামও বেশ ভালো পাচ্ছেন কৃষকরা।

পুষ্টিগুণ সম্পর্কে জানতে চাইলে পুষ্টিবিদ তাসলিমা আক্তার উর্মি বলেন, তরমুজ একটি সবুজ মোটা খোসাযুক্ত গোল বৃত্তে আবৃত লাল রসালো ফল। এ ফলে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন আছে, আছে মিনারেল, অ্যামাইনো অ্যাসিড, অ্যান্টিঅক্সিজেনের মতো নানা উপাদান। এ ছাড়া তরমুজ শরীরে পানির অপূর্ণতা পূরণেও বেশ সহায়ক।

তরমুজ একাধারে রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে যেমন সহায়তা করে তেমনি হৃদযন্ত্রের সুস্থতায় বেশ উপকারী এ মৌসুমি ফল তরমুজ। অন্যদিকে এ ফলের ক্যান্সারের মতো রোগ প্রতিরোধের ক্ষেত্রেও বেশ কার্যকর। তরমুজে থাকা বিশেষ উপাদান ক্যান্সারের কোষ বৃদ্ধি রোধে বেশ কাজ করে। যারা অতিরিক্ত ওজন নিয়ে সমস্যায় ভুগছেন তাদের খাদ্য তালিকায় জায়গা করে নিতে এ ফলটি।

তরমুজ ওজন কমাতে সহায়তা করে তেমনি আপনার শরীরের কার্যক্ষমতা, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতেও বেশ সহায়ক। অতিরিক্ত চর্বি কমাতেও তরমুজ খুব দ্রুত সহায়তা করে। তরমুজে আছে বিটা ক্যারোটিন, ম্যাগানিজ যা আপনার ত্বক মসৃণ করে সঙ্গে ব্রণের সমস্যা দূর করতেও বেশ সহকারী। তরমুজ ত্বকের জন্য বেশ উপাকারী।


পিএনএস/এমএইউ

@PNSNews24.com

আপনার মন্তব্য প্রকাশ করুন