পিএনএস ডেস্ক: বহুত্ববাদ ও ধর্মনিরপেক্ষ ঐতিহ্যের ওপর ভারতের যে নৈতিক ভিত্তি দাঁড়িয়ে আছে, সেটিকে এই আইন নাড়িয়ে দিয়েছে। আমি পার্লামেন্টে দাঁড়িয়ে বলেছি, আমাদের পূর্বসূরিরা ধর্মীয় বৈষম্য মুক্তির সনদ হিসেবে যে সংবিধান রেখে গেছেন, এই আইন সেটিকে স্পষ্টভাবে লঙ্ঘন করেছে।
ভারতের স্বাধীনতাসংগ্রাম যখন চূড়ান্ত সাফল্যকে ছুঁই ছুঁই করছিল, ঠিক তখন ধর্মের ভিত্তিতে ভারতীয় জাতীয়তাকে দুই ভাগ করে ফেলা হয়েছিল। মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ এবং তাঁর অনুসারীরা যুক্তি দিয়েছিলেন, মুসলমানদের জন্য পাকিস্তান নামে আলাদা দেশ হওয়া উচিত। মহাত্মা গান্ধী ও জওহরলাল নেহরু এবং তাঁদের অনুসারীরা বলেছিলেন, একটি জাতির ভিত্তি ধর্ম হতে পারে না। ভাষা, ধর্ম, জাত-পাতের ভিত্তিতে ভারতীয়রা ভাগ হতে পারে না। সেই মূলমন্ত্রের বিরোধিতা করে মোদি সরকার এখন হিন্দুত্ববাদ নিয়ে উন্মাদনায় মেতে উঠেছে।
নতুন বিল অনুযায়ী, অভিবাসী মুসলমানদের হয়তো অবৈধ ঘোষণা করা হতে পারে। এর বাইরে মোদি সরকার ন্যাশনাল রেজিস্ট্রার অব সিটিজেনস বা এনআরসি নামের যে উদ্যোগ নিচ্ছে, সেটি আরও বড় সমস্যা তৈরি করবে। এর ফলে যে মুসলমান নাগরিক তাঁর ভারতীয় নাগরিকত্বের সপক্ষে প্রমাণপত্র হাজির করতে পারবেন না, তাঁকেও অনাগরিক ঘোষণা করা হবে। ভারতের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর একটা বিরাট অংশের কাছে তাঁদের জন্মবিষয়ক নথিপত্র নেই। এই অল্প কিছুদিন আগেও ভারতে ব্যাপকভাবে জন্মসনদ গ্রহণের প্রবণতা ছিল না। অমুসলিমরা নথিপত্র যদি দেখাতে না পারেন তাহলে তাঁদের অসুবিধা হবে না। কিন্তু মুসলিমদের হাতে নথিপত্র না থাকলে তাঁদের বিপদে পড়তে হবে। এই ভয়ানক পদক্ষেপের কারণে ভারতের শতাব্দীপ্রাচীন সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য হুমকির মুখে পড়েছে।
গণতান্ত্রিক ভারতে নাগরিকত্ব ইস্যুতে কখনোই ধর্মীয় পরিচয় চাওয়া হয়নি। রাষ্ট্রপতি, জেনারেল, মুখ্যমন্ত্রী, রাজ্যপাল, রাষ্ট্রদূত, সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি এবং জাতীয় খেলাধুলার টিমের ক্যাপ্টেন ইত্যাদি পদে মুসলমানরা এসেছেন। যে ধর্মীয় উন্মাদনা ভারতকে ভাগ করেছিল এবং পাকিস্তানের সৃষ্টি করেছিল, সেই উন্মাদনা এখন আবার বহুত্ববাদের দেশ ভারতে মাথাচাড়া দিয়েছে। পার্লামেন্টে আমি যেমনটা বলেছি, তখন ভারতের মাটিকে আলাদা করা হয়েছিল আর এখন ভারতের আত্মাকে ভাগ করা হচ্ছে।
এখন জনবিক্ষোভ ছড়াচ্ছে। আসামের নাগরিকদের মধ্যে এই ভয় ঢুকে গেছে যে এনআরসির মাধ্যমে বাংলাদেশ থেকে আসা হিন্দুদের দ্রুত নাগরিকত্ব দেওয়া হবে। এ কারণে অসমিয়ারা এনআরসির বিরোধিতা করে বিক্ষোভ করেছেন। পশ্চিমবঙ্গ ও দিল্লিতে মুসলমানদের মধ্যে এই ভয় দানা বাঁধছে যে তাঁদের নাগরিকত্ব বাতিলের চেষ্টা চলছে। বিক্ষোভগুলো শান্তিপূর্ণ থাকার পরও প্রশাসন বলপ্রয়োগ করেছে।
আসামে ও লক্ষ্ণৌতে গুলিতে কয়েক ডজন লোক মারা গেছে। যেসব জায়গায় বিক্ষোভ হয়েছে তার কোথাও কোথাও কারফিউ দেওয়া হয়েছে। কোথাও কোথাও ইউনিভার্সিটিতে ঢুকে পুলিশ লাঠিপেটা করেছে। কোথাও কোথাও ইন্টারনেট বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। শতাধিক লোক গুরুতর আহত হয়েছে। জোর করে চাপিয়ে দেওয়া এই সংঘাতের ক্ষত শুকাতে বহু সময় লেগে যাবে।
প্রথম মেয়াদে মোদি নির্লজ্জভাবে ভারতকে ‘হিন্দু ভারত’ বানানোর চেষ্টা করার পরও আন্তর্জাতিক বিনিয়োগকারীরা এখানে বিনিয়োগে আগ্রহী ছিল। কিন্তু দ্বিতীয় মেয়াদের প্রথম ছয় মাসেই তিনি যেভাবে মুসলিম বিদ্বেষ সামনে এনেছেন, তা সবাইকে উদ্বিগ্ন করে তুলেছে। ইসলামি শরিয়াহর তিন তালাক বাতিল করা, ভেঙে ফেলা বাবরি মসজিদের স্থলে রামমন্দির বানানোর বিষয়টিকে আরও এগিয়ে নেওয়া, মুসলিম–অধ্যুষিত জম্মু ও কাশ্মীরের সাংবিধানিক স্ট্যাটাস ছিনিয়ে নেওয়া এবং সর্বশেষ এই নাগরিকত্ব বিল পাস—এসব হিন্দু-মুসলমানের ঐক্যকে ভেঙে দিচ্ছে। নাগরিকত্ব বিল পাসের পর জাপানের প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবে তাঁর নির্ধারিত ভারত সফর বাতিল করেছেন। বিদেশি বিনিয়োগকারীরা ফিরে যেতে শুরু করেছেন। নোট বাতিল ও জিএসটি চালুর সুবাদে অর্থনীতির যে ক্ষতি মোদি সরকার করে ফেলেছে, তা সারাই করা শিগগির সম্ভব হবে না। অর্থনৈতিক ক্ষতির পাশাপাশি ভারতীয় চেতনা যেভাবে ক্ষতির মুখে পড়েছে, তা সারিয়ে তোলা যাবে কি না, সেটাই এখন ভাবার বিষয়।
ইংরেজি থেকে অনূদিত। স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট
শশী থারুর ভারতের সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী
পিএনএস/আনোয়ার
মোদির দ্বিতীয় ভারত ভাগ
26-12-2019 04:00PM