পিএনএস ডেস্ক: ন্যায্য অধিকার আদায়ে ১৮৮৬ সালের মে মাসে আমেরিকার শিকাগো শহরের রাজপথ শ্রমিকের রক্তে রঞ্জিত হয়েছিল। ১৮৮৬ থেকে ২০২৪। কেটে গেছে শ্রমের মর্যাদা, মূল্য ও ন্যায্য মজুরি শুধু নয়, যুক্তিসংগত কর্ম সময় নির্ধারণের আন্দোলনের ১৩৮ বছর। এ সময় পরিবর্তন হয়েছে মানুষের সমাজ ও সভ্যতার। আর সভ্যতার কারিগর শ্রমিকরাই। যুুগে যুগে তাদের অবদান তাই অনস্বীকার্য। দীর্ঘ এ পথ পাড়ি দিতে শ্রমিকের সহযাত্রী হয়েছিল দেশ-বিদেশের অসংখ্য শ্রমিক সংগঠন। জানব সেসব গল্প...
১ মে পৃথিবীর ৮০টি দেশে মে দিবস বা আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস উপলক্ষে সরকারি ছুটি থাকে। পৃথিবীর অধিকাংশ দেশেই শ্রমিকদের অধিকার প্রতিষ্ঠা এবং স্বার্থরক্ষায় এ দিনে বিভিন্ন কর্মসূচি নেওয়া হয়। এ দিনে শ্রমিকদের নিয়ে যারা ভাবেন, তারা স্মরণ করেন ১৮৮৬ সালে আমেরিকার শিকাগো শহরের হে মার্কেট স্কয়ারে ঘটে যাওয়া করুণ কাহিনির।
যদিও এই করুণ কাহিনির সূত্রপাত হয়েছিল আরও আগে। অষ্টাদশ শতাব্দীর শুরুতে ইংল্যান্ডের সমাজবিজ্ঞানী ও সমাজ সংস্কারক রবার্ট ওয়েন সর্বপ্রথম শ্রমিকদের আট ঘণ্টা শ্রম, আট ঘণ্টা মনোরঞ্জন এবং আট ঘণ্টা বিশ্রামের তত্ত্ব দিয়ে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করেন। কিন্তু দ্রুত শিল্পায়ন আর অধিক মুনাফার জন্য শিল্পমালিকরা শ্রমিকদের কাজের কোনো সময় বেঁধে দিতে রাজি ছিলেন না।
এ সময় শ্রমিকরা সপ্তাহের ছয় দিনে দৈনিক ১০ থেকে ১৪ ঘণ্টা, এমনকি তারও বেশি সময় কাজ করতে বাধ্য হতো। তাই শ্রমিক সংগঠন এবং প্রতিবাদী শ্রমিকরা সর্বোচ্চ আট ঘণ্টা শ্রমের দাবিতে ইউরোপজুড়ে আন্দোলন ছড়িয়ে দেন। শিল্পসমৃদ্ধ আমেরিকার শিকাগো শহরে ১৮৮৬ সালের এপ্রিল শেষে এই আন্দোলন প্রবল গতি লাভ করে।
এর দুই বছর আগে ১৮৮৪ সালের অক্টোবরেই আমেরিকার ফেডারেশন অব অর্গানাইজড ট্রেডস অ্যান্ড লেবার ইউনিয়ন সময় বেঁধে দিয়েছিল ১ মে ১৮৮৬ তারিখের মধ্যে আট ঘণ্টা শ্রমের বিষয়টিকে মানদন্ড হিসেবে বিবেচনা করতে হবে। এর সমর্থনে ১ মে ১৮৮৬ আমেরিকাজুড়ে হরতাল ও বিক্ষোভ কর্মসূচি দেওয়া হয়। প্রথম তিন দিনে মিছিল আর বিক্ষোভে উত্তাল হয়ে ওঠে আমেরিকার শিকাগো শহর।
কী ঘটেছিল সেদিন?
১৩৮ বছর আগে, ১৮৮৬ সালের ৪ মে শ্রমিকদের ন্যায্য অধিকার আদায়ে ইংরেজি এবং জার্মান ভাষায় লেখা একটি লিফলেট প্রকাশিত হয়। তাতে বড় অক্ষরে লেখা- ‘ওয়ার্কিংম্যান, টু আর্মস’। লিফলেটের মাধ্যমে শ্রমিকদের শিকাগো শহরের হে মার্কেট চত্বরে জড়ো হতে বলা হয়। তার আগের দিন ‘ম্যাককরমিক রিপার্স’ কারখানায় এক জার্মান অভিবাসী শ্রমিক নেতা অগাস্ট স্পাইস বিক্ষোভকারীদের ডাকা হরতাল ও বিক্ষোভে অসংখ্য হত্যাকান্ড দেখেন। যা দেখে তিনি দৌড়ে তার অফিসে যান এবং লিফলেট ছাপান। বলে রাখা ভালো- স্পাইস নিজে একটি জার্মান সংবাদপত্র চালাতেন।
হত্যার খবর এবং লিফলেট দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। ‘হে মার্কেট চত্বর’ ছিল শহরের একটি ব্যস্ত অংশ। যেখানে ছিল যাত্রীছাউনি, অসংখ্য গাড়ির দোকান এবং কাছাকাছি বেশ কয়েকটি কারখানা। সেদিন হালকা বৃষ্টি উপেক্ষা করে মিছিল বের করে আন্দোলনত শ্রমিকরা। রাত সাড়ে ৮টা নাগাদ দুই হাজারের বেশি অভিবাসী শ্রমিক হে মার্কেট চত্বরে জড়ো হয়। এরপর হে মার্কেট চত্বরে শুরু হয় বক্তৃতা পর্ব। ওই সময় শেষ বক্তা হিসেবে ভাষণ দেন আমেরিকার সমাজ সংস্কারক ও শ্রমিক নেতা স্যামুয়েল ফিলডেন। যদিও দিনটি ছিল ঠান্ডার। তাপমাত্রার পারদ ছিল ১০ ডিগ্রি সেলসিয়াস।
কিন্তু তার উত্তেজনাপূর্ণ বক্তৃতা বাতাস ভারী করে তোলে। তাতে সমর্থন দেয় শ্রমিকেরা। রাত সাড়ে ১০টায় তার বক্তৃতা শেষ হতেই এগিয়ে আসে পুলিশ বাহিনী এবং সভাস্থল ছেড়ে সবাইকে চলে যেতে হুকুম দেয়। এমনি এক মুহূর্তে পুলিশের এগিয়ে আসা পথে ঘরে তৈরি একটি বোমা বিস্ফোরিত হয়। এতে ঘটনাস্থলেই এক পুলিশ সদস্য নিহত হন। আহত হন আরও ৬৬ জন। যার মধ্যে ছয়জন পুলিশ সদস্য পরবর্তী সময়ে মারা যান। অন্যদিকে বোমা বিস্ফোরণের পর উভয়পক্ষে গুলিবিনিময় শুরু হয় বলে পুলিশ দাবি করলেও ঐতিহাসিকদের মতে, এ সময় পুলিশই শ্রমিকদের ওপর গুলি ছোড়ে এবং নিজেদের গুলিতেই তারা মারা যায়। মুহূর্তেই ফাঁকা হয়ে যায় হে মার্কেট চত্বর, রাস্তায় পড়ে থাকে শ্রমিকের রক্তাক্ত লাশ।
যদিও বলা হয় এতে চারজন শ্রমিক নিহত এবং ৬০ জন আহত হন। প্রকৃত সত্য অনেকটাই আড়ালে ঢাকা পড়ে। কিন্তু আড়ালে থাকে না তথাকথিত বিচারকাজ। আন্দোলনকারী শতাধিক শ্রমিককে গ্রেফতার করা হয়। শুরু হয় বিচারের পালা। বিচার শেষে জুরি বোর্ড আট প্রতিবাদীকে মৃত্যুদন্ড প্রদানের পক্ষে মত দিলেও বিচারক সাতজনকে মৃত্যুদন্ড এবং একজনকে ১৫ বছরের কারাদন্ড প্রদান করেন।
উচ্চ আদালতও একই রায় বহাল রাখে। আমেরিকার অঙ্গরাজ্য ইলিনয়ের গভর্নর রিচার্ড জেমস প্রতিবাদী শ্রমিক নেতা ফিলডেন এবং স্ত্রোয়ারের মৃত্যুদন্ড মওকুফ করে ১০ নভেম্বর ১৮৮৭ যাবজ্জীবন কারাদন্ড প্রদান করেন। এরপর শুরু হয় বাকি পাঁচজনের মৃত্যুর প্রহর গোনার পালা। কিন্তু এ দিনই ঘটে আরেক বিষাদময় ঘটনা। লিঞ্জ নামের এক সাজাপ্রাপ্ত বিপ্লবী শ্রমিক কৌশলে চুরুট বা মোটা সিগারেটের মতো দেখতে বিশেষ ধরনের হাতে তৈরি বোমা (ব্লাস্টিং ক্যাপ) সংগ্রহ করেন। চুরুটের মতোই তা মুখে পুরে তিনি এতে বিস্ফোরণ ঘটান। মুহূর্তেই লিঞ্জের মুখের বিরাট অংশ আলগা হয়ে খসে পড়ে।
তারপরও ছয় ঘণ্টা বেঁচে ছিলেন লিঞ্জ। পরদিন ১৮৮৭ সালের ১১ নভেম্বর অবশিষ্ট চার বিপ্লবী শ্রমিক এঞ্জেল, ফিসার, পারসন্স এবং স্পাইসকে নেওয়া হয় ফাঁসির মঞ্চে। ফাঁসির মঞ্চের দিকে এগোতে এগোতে তারা শ্রমিকদের অধিকারের কথা নিয়ে রচিত গণসংগীত ও বিপ্লবী গান গেয়ে যান। ফাঁসিতে ঝোলানোর ঠিক পূর্ব মুহূর্তে স্পাইস বলে যান, ‘এমন একদিন আসবে যেদিন আমাদের নীরবতা (মৃত্যু) তোমরা যে কণ্ঠকে স্তব্ধ করতে চাও, তার চেয়েও শক্তিশালী হবে।’ বৃথা যায়নি শ্রমিক নেতা স্পাইসের গর্জন।
শ্রমজীবীদের সংগঠন
আইএলআরএফ :
আশির দশকের শুরু থেকে বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন এবং শ্রমিক সংগঠন আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে শ্রমিকদের অধিকার প্রতিষ্ঠার গুরুত্ব অনুধাবন করতে থাকে। এক সময় তারা আমেরিকায় একটি সংগঠন এবং ফান্ড গঠন করে। উদ্দেশ্য ছিল আন্তর্জাতিকভাবে শ্রমিকদের অধিকার প্রতিষ্ঠা এবং প্রশিক্ষণ ও গবেষণা পরিচালনা করা। সেই সংগঠনটিই পরবর্তীতে ইন্টারন্যাশনাল লেবার রাইট ফোরাম (আইএলআরএফ) নামে আত্মপ্রকাশ করে। তাদের মূল উদ্দেশ্য বিশ্বব্যাপী শ্রমিকদের প্রতি ন্যায়বিচার ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা করা। সংগঠনটির মতে, পৃথিবীতে এমন অসহায় শ্রমিকের মধ্যে কেবল শিশু শ্রমিকের সংখ্যাই ২০ কোটির বেশি, যাদের বয়স পাঁচ থেকে ১৪ বছর। এই শিশু শ্রমিকদের একটা অংশ কখনো কখনো বিনা পারিশ্রমিক বা নামমাত্র পারিশ্রমিকে কাজ করতে বাধ্য হয়। এ সংগঠনের মূলনীতির মধ্যে রয়েছে- শিশু শ্রমের অবসান, নারী শ্রমিকের অধিকার প্রতিষ্ঠা, শ্রমিকের জন্য উপযুক্ত নিরাপদ কর্মক্ষেত্র প্রতিষ্ঠা এবং স্বাধীনভাবে শ্রমিক সংগঠনের কাজে অংশ নেওয়ার পরিবেশ তৈরি। সংগঠনটি এনজিও, বিভিন্ন দেশের সরকার এবং স্থানীয় শ্রমিক সংগঠনগুলোর সঙ্গে কাজ করে।
আইএলও :
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সমাপ্তি ঘটে ১৯১৯ সালে ভার্সাইল চুক্তি অনুসারে। ওই চুক্তির অংশ হিসেবে ইন্টারন্যাশনাল লেবার অর্গানাইজেশন (আইএলও) জন্মলাভ করে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর বিশ্ব নেতারা অনুধাবন করেন সত্যিকারের শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য সমাজে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা অত্যন্ত জরুরি। আর সমাজের অবিচ্ছেদ্য অংশ হলো শ্রমিক। সুতরাং শ্রমিকরা যদি ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হয়, তাহলে সমাজে শান্তির পরিবর্তে সংঘাত আসতে বাধ্য। এই অনুধাবন থেকেই জন্ম নেয় লিগ অব ন্যাশনস যা পরবর্তীতে বর্তমান জাতিসংঘে রূপ নেয়। আর জাতিসংঘের এজেন্সি হিসেবে কাজ করে আইএলও।
জাতিসংঘের প্রায় সব কটি রাষ্ট্র আইএলওর সদস্য। সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় সংগঠনটির সদর দফতর। তারা শ্রমিকদের স্বার্থরক্ষায় নানা তৎপরতা চালায়। তন্মধ্যে রয়েছে দৈনিক ও সাপ্তাহিক সর্বোচ্চ কাজের সময় নির্ধারণ, ন্যায্য মজুরি নিশ্চিত করা, যে কোনো বিপদ থেকে শ্রমিকদের রক্ষা, শিশু-কিশোর ও নারী শ্রমিকদের সুরক্ষা, প্রবাসী শ্রমিকদের স্বার্থরক্ষা, মজুরির ক্ষেত্রে সমতা বিধান, শ্রমিক সংগঠন করার অধিকার নিশ্চিত এবং কর্মমুখী ও কারিগরি প্রশিক্ষণে সহায়তা ইত্যাদি। ১৯৬৯ সালে আইএলও সংগঠনটি নোবেল শান্তি পুরস্কার লাভ করে।
এফডব্লিউএফ :
এটি নেদারল্যান্ডসভিত্তিক একটি স্বাধীন অলাভজনক ও অরাজনৈতিক সংগঠন। এই সংগঠনটি কোম্পানি এবং পোশাক তৈরির কারখানাগুলোকে পোশাক শ্রমিকদের জন্য উন্নত কাজের পরিবেশ সৃষ্টিতে এই সংগঠনের সঙ্গে সংযুক্ত বাংলাদেশসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে অবস্থিত ৮০টি সদস্য কোম্পানি ১২০টি ব্র্যান্ডের পোশাক তৈরি করে। আর ৮০টিরও বেশি দেশের ২০ হাজার আউটলেট বা দোকানে বিক্রি হয় এই পোশাক। এশিয়া, ইউরোপ এবং আফ্রিকার ১৫টি তৈরি পোশাক উৎপাদনকারী দেশে এফডব্লিউএফের কার্যক্রম বিস্তৃত। মূলত পোশাক তৈরি কারখানাগুলো শ্রমিকদের স্বার্থরক্ষা ও কল্যাণে যে পদক্ষেপ নেয়, তা বেগবান ও শক্তিশালী করতে সচেষ্ট এফডব্লিউএফ।
এই লক্ষ্যে আট ধারা বা কোড অব কন্ডাক্ট নির্ধারণ করা হয়েছে। যেমন- স্বেচ্ছায় চাকরিতে যোগদান, বৈষম্যহীন চাকরি, শিশুশ্রম বন্ধ করা, সংগঠন করার অধিকার, ন্যায্য ন্যূনতম মজুরি, অতিরিক্ত পরিশ্রম রোধ, নিরাপদ ও স্বাস্থ্যসম্মত কর্মক্ষেত্র সৃষ্টি এবং আইনসম্মতভাবে শ্রমিকদের সঙ্গে সুসম্পর্ক সৃষ্টি ইত্যাদি। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের একাধিক সংগঠনের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে এফডব্লিউএফ পোশাক শ্রমিকদের স্বার্থ রক্ষায় ইতিবাচক ভূমিকা রাখছে। সাভারের রানা প্লাজায় সাম্প্রতিক ধস এবং পোশাক শ্রমিকদের ক্ষয়ক্ষতি হওয়ায় তাদের ওয়েবসাইটে দুঃখ ও সমবেদনা জানিয়েছে এফডব্লিউএফ।
বিখ্যাত শ্রমিক নেতা
সিজার ক্যাভেজ -আমেরিকা :
শ্রমিক আন্দোলন বিশেষত কৃষকদের অধিকার আদায়ের ক্ষেত্রে আমেরিকা ও ল্যাটিন আমেরিকার বিভিন্ন দেশে অমর হয়ে আছেন সিজার ক্যাভেজ (১৯২৭-৯৩)। তার হাত ধরেই গড়ে উঠেছিল আমেরিকার ‘ন্যাশনাল ফার্ম ওয়ার্কার্স অ্যাসোসিয়েশন’ যা পরবর্তীতে ‘এগ্রিকালচারাল ওয়ার্কার্স অর্গানাইজিং কমিটি’ ও ‘ইউনাইটেড ফার্ম ওয়ার্কার্স লেবার ইউনিয়ন’-এর সঙ্গে অঙ্গীভূত হয়। তাকে মূলত বাম ঘরানার রাজনীতিবিদ ও শ্রমিক নেতা এবং খ্রিস্টীয় ক্যাথলিক বলে গণ্য করা হয়। সাধারণ কৃষি শ্রমিক হিসেবে তার কর্মজীবন শুরু হয়।
পরবর্তীতে তিনি দুই বছর আমেরিকার নৌবাহিনীতে চাকরি করেন। নৌবাহিনীর চাকরি ছেড়ে যুক্ত হন কমিউনিটি সার্ভিস অর্গানাইজেশন বা সমাজসেবা কার্যক্রমের সঙ্গে। এই কার্যক্রমের মাধ্যমে তিনি শ্রমিকদের ভোটাধিকার, জীবন বীমা ও ঋণ পাওয়ার অধিকার নিশ্চিত করেন। তার উদ্যোগে শ্রমিকদের মুখপত্র হিসেবে একটি সংবাদপত্রের প্রকাশনা শুরু হয়।
১৯৬৫ সালে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে কৃষক ও শ্রমিকদের আন্দোলন, হরতাল ও বয়কট শুরু হয়। তার নেতৃত্বে ছিলেন সিজার। মূলত মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য বিনাশ করে প্রকৃত উৎপাদক তথা কৃষকদের আঙুরের যৌক্তিক মূল্য নিশ্চিত করতে এই আন্দোলন। দীর্ঘ পাঁচ বছর পর ১৯৭০ সালে কর্তৃপক্ষ আঙুর চাষিদের দাবিদাওয়া মেনে নিতে বাধ্য হয়। এ দাবি আদায়ের সংগ্রাম চলাকালে তিনি ও তার সঙ্গীরা মহাত্মা গান্ধীর অহিংস আন্দোলনের পথ অনুসরণ করেন। তার আদর্শ পরবর্তীতে পৃথিবীর বহু দেশে ছড়িয়ে পড়ে। সামান্তবাদী ও পুঁজিপতিরা তার বিরুদ্ধে বহু কুৎসা রটনা করে এবং আইনগত ঝামেলা তৈরি করে। সব বাধা পেরিয়ে তিনি এক কিংবদন্তি শ্রমিক নেতারূপে আবির্ভূত হন। ১৯৯৪ সালে আমেরিকার মরণোত্তর প্রেসিডেন্ট পদক লাভ করেন এবং ফক’স অ্যাঞ্জেল বা জনতার দেবতা উপাধি পান।
স্যামুয়েল গমপার্স ,ইংল্যান্ড-আমেরিকা :
‘বন্ধুদের নির্বাচিত কর এবং শত্রুদের হারিয়ে দাও’- এই বাণী দিয়ে শ্রমিকদের ঐক্যবদ্ধ, উদ্বুদ্ধ ও সংঘবদ্ধ করে কায়েমি তথা স্বার্থান্বেষী মহলকে বারবার পরাজিত করে শ্রমিক আন্দোলনের ইতিহাসে অনুকরণীয় হয়ে আছেন ব্রিটিশ বংশোদ্ভূত আমেরিকার শ্রমিক নেতা স্যামুয়েল গমপার্স (১৮৫০-১৯২৪)। পূর্ব লন্ডনের এক দরিদ্র এলাকায় সাধারণ সিগারেট (সিগার) শ্রমিকের ঘরে জন্ম নেন স্যামুয়েল। ছয় বছর বয়সে স্কুলে ভর্তি হলেও মাত্র ১০ বছর বয়সে স্কুল ছেড়ে তাকে উপার্জনের জীবন বেছে নিতে হয়। তবে পড়ার প্রতি আগ্রহের কারণে তিনি শ্রমজীবীদের রাত্রিকালীন স্কুলে লেখাপড়া চালিয়ে যান। ১৩ বছর বয়সে দারিদ্র্যের কশাঘাতে জর্জরিত পরিবারের সঙ্গে স্যামুয়েল গমপার্স আমেরিকার নিউইয়র্কে এক শ্রমিক অধ্যুষিত এলাকায় গমন করেন। এখানে পিতাপুত্র ঘরে বসেই সিগারেট (সিগার) তৈরি ও বাজারজাত করতে থাকেন। এরই মাঝে অবসরে বন্ধুদের সঙ্গে নিয়ে স্যামুয়েল বিতর্ক ক্লাব গড়ে তোলেন।
এই ক্লাবে তিনি বক্তৃতার কলাকৌশল রপ্ত করেন এবং অন্যান্য ক্লাবের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে থাকেন, যা তাকে ভালো রাজনৈতিক বক্তা হতে সাহায্য করে। ১৫ বছর বয়সে তিনি সিগারেট শ্রমিক সংগঠনের সদস্য হন এবং পরবর্তীতে শ্রমিক নেতা হয়ে ওঠেন। ২৫ বছর বয়সে তিনি শ্রমিকদের আন্তর্জাতিক সংগঠনের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। শ্রমিকদের অধিকার রক্ষায় তার কার্যক্রম বিশেষত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধসহ বিভিন্ন দেশে আমেরিকার অভিযানের বিরুদ্ধে তার অবস্থান তাকে বিতর্কিত করে তোলে। ৭৩ বছর বয়সে তিনি ইনফ্লুয়েঞ্জা, ব্রঙ্কাইটিস, ডায়াবেটিস ও হৃদরোগে আক্রান্ত হন। তবুও তিনি শ্রমিকদের অধিকার আদায়ে দেশ-বিদেশে ছুটেছেন। ১৯২৪ সালে মেক্সিকোতে শ্রমিক সমাবেশে যোগ দিতে গিয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েন। তিনি চেয়েছিলেন তার মৃত্যু যেন আমেরিকায় হয়। শেষ ইচ্ছাকে সম্মান জানিয়ে তাকে দ্রুত আমেরিকায় পাঠানো হয়। কিন্তু পথিমধ্যেই এই নেতা মারা যান।
আনাসুয়া সারাভাই, ভারত :
ভারতের ইতিহাসে অহংকার হয়ে আছেন আনাসুয়া সারাভাই (১৮৮৫-১৯৭২) নামের এক অনন্যা মহিলা সমাজকর্মী। গুজরাটে তার পরিচয় ‘মাতাবেন’ নামে, যার অর্থ বড় বোন। তিনি ভারতের প্রথম শ্রমিক নেত্রী এবং ভারতের প্রাচীনতম শ্রমিক সংগঠন ‘আহমেদাবাদ টেক্সটাইল লেবার অ্যাসোসিয়েশন’-এর প্রতিষ্ঠাতা। ১১ নভেম্বর ১৮৮৫ সালে যখন আনাসুয়া সারাভাই জন্মগ্রহণ করেন তখন ভারতে মহিলাদের কোনো চাকরি বা প্রতিষ্ঠা পাওয়ার সুযোগ ছিল না। মাত্র ৯ বছর বয়সে বাবা-মাকে হারিয়ে তিনি ভাই ও বোনকে নিয়ে চাচার আশ্রয়ে চলে যান। ১৩ বছর বয়সে তাকে বিয়ে দেওয়া হলেও অল্প দিনের মধ্যেই তা ভেঙে যায়। এরপর তিনি ইংল্যান্ডে ভাইয়ের কাছে চলে যান এবং মেডিকেল বিষয়ে লেখাপড়া শুরু করেন। পরবর্তীতে তা ছেড়ে অর্থনীতিতে পড়ালেখা করেন।
এরপর ভারতে এসে মেয়েদের ভাগ্যোন্নয়নে মাঠে নামেন। তিনি মূলত বস্ত্রকলে কর্মরত মহিলা শ্রমিক ও তাদের কন্যাদের জন্য স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন, যেখানে জাতি-বর্ণ-নির্বিশেষে সবাই লেখাপড়া করতে পারত। তিনি মেয়েদের জন্য পৃথক টয়লেট, প্রসূতিঘর, মহিলা নিবাস প্রভৃতি প্রতিষ্ঠা করেন। এক দিন তিনি একদল মহিলা শ্রমিকের সাক্ষাৎ পান যারা টানা ৩৬ ঘণ্টা বস্ত্রকলে কাজ করে ক্লান্ত দেহে ঘরে ফিরছিল। এমন ঘটনাকে তিনি দাস প্রথার সঙ্গে তুলনা করেন এবং প্রতিরোধে বস্ত্রকলের শ্রমিকদের নিয়ে হরতাল শুরু করেন। তার আপন ভাই তখন মিল মালিকদের সংগঠনের প্রধান ছিলেন। ফলে ভাইয়ের সঙ্গেও তার দ্বন্দ্ব শুরু হয়। তবে সারাভাই নিজ দাবিতে অটল থাকেন এবং টানা ২১ দিন হরতাল করে দাবি আদায় করেন। তিনি মহাত্মা গান্ধীর অনুসারী ছিলেন এবং গান্ধীজিও তার আন্দোলনকে সমর্থন করতেন এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে চিঠি লিখে তার আন্দোলনের সপক্ষে কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ জানাতেন। ১ নভেম্বর ১৯৭২ সালে লাখো মহিলার চোখের জলে সিক্ত হয়ে সারাভাই পৃথিবী ত্যাগ করেন।
দেশে দেশে আলোচিত শ্রমিক আন্দোলন-
অনেক অনেক বছর আগে...
৩ হাজার বছর আগের কথা। রাজা তৃতীয় রামসেসের রাজত্বকালে মিসরে প্রথম শ্রমিক ধর্মঘট হয়েছিল। তাদের প্রত্যেকে ছিল বংশগত কারিগর। দেইর এল মদিনা নগরীতে ফারাহদের সমাধি নির্মাণের জন্য তাদের নিযুক্ত করা হয়েছিল। জানা গেছে, দীর্ঘ ১৮ দিন কারিগররা তাদের রেশন পায়নি বলে সে সময় সব কার্যক্রম বন্ধ করে দিয়েছিল।
১১৬ দিনের ধর্মঘটের অবসান...
এই ধর্মঘট মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইস্পাত শিল্পকে প্রায় ধ্বংস করে দিয়েছিল। সময়টা তখন ১৯৫৯ সালের ১৫ জুলাই। প্রায় ৫ লাখ ইস্পাত শ্রমিক সেদিন ভালো বেতনের দাবিতে ধর্মঘট করেছিল। একপর্যায়ে তারা সবার সম্মতিতে ইউনিয়ন চুক্তির একটি ধারা অপসারণে আন্দোলন করে। ধারাটির কারণে শ্রমিক চাকরি ঝুঁকিতে ছিল। তৎকালীন ধর্মঘটের কারণে বন্ধ হয়ে যায় ইস্পাত উৎপাদন। কোম্পানিগুলো জাপান এবং দক্ষিণ কোরিয়া থেকে সস্তায় ইস্পাত আমদানি করে। পরে আদালত এবং মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোয়াইট আইজেনহাওয়ারের হস্তক্ষেপে ১১৬ দিনের ধর্মঘট শেষ হয়।
২০ দিন পর কাজে ফিরতে বাধ্য হয়
১৯৭৪ সালের ৮ মে গোটা ভারতের রেল শ্রমিকেরা ধর্মঘট করেছিল। উন্নত কাজের ব্যবস্থা এবং ভালো মজুরির দাবিতে সংগঠিত হয়েছিল সেই ঐতিহাসিক আন্দোলন। প্রায় ১৭ লাখ ভারতীয় রেলওয়ে শ্রমিক সেদিন ন্যায্য মজুরি আদায়ে কাজ বন্ধ করে দেয়। নিজেদের ন্যায়সঙ্গত দাবি আদায়ে চরম রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে ২০ দিন ধরে ধর্মঘট চালিয়েছিলেন তাঁরা। যদিও তা বেশিদূর এগোয়নি। ক্ষমতাসীনদের চাপে ২০ দিন পর শ্রমিকরা কাজে ফিরতে বাধ্য হয়।
দ্রব্যমূল্যের বৃদ্ধিতে হয়েছিল শ্রমিক আন্দোলন
১৯৮০ সালের জুলাই মাসে পোল্যান্ডে শ্রমিকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে একটি ধর্মঘট শুরু করলে সোভিয়েত কমিউনিজমের মৃত্যুঘণ্টা বেজে ওঠে। মাংস এবং অন্যান্য দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে তীব্র প্রতিবাদ করছিলেন তারা। শ্রমিক আন্দোলনের কেন্দ্রস্থল ছিল গডানস্ক শিপইয়ার্ড। আর তাদের নেতৃত্ব দিয়েছিল স্বাধীন ইউনিয়ন সলিডারিটি। তৎকালীন গোটা পোল্যান্ডে সামরিক আইন সত্ত্বেও শ্রমিকরা অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য তাদের লড়াই চালিয়ে যায়।
ক্ষমতা হারানোর ধর্মঘট
১৯৮২ সালের ১৮ জানুয়ারি যখন সামন্ত দত্ত মুম্বাইয়ের ৫০-এর বেশি টেক্সটাইল মিলের প্রায় ২ লাখ ৫০ হাজার শ্রমিকের ধর্মঘটে নেতৃত্ব দেন, তখন তিনি ভারতের খেটে খাওয়া মানুষের ত্রাতা হয়ে উঠেছিলেন। শ্রমিকরা তাদের বেতন বৃদ্ধির দাবি জানিয়ে আসছিল। কিন্তু সরকার বা মিল মালিক কেউই তাদের কথা শোনেনি। অতঃপর ধর্মঘটে সব মিল-প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ হয়ে যায়। ফলে ১ লাখের বেশি শ্রমিক বেকার হয়ে পড়েছিল। ভারতের শ্রমিক আন্দোলনের ইতিহাসে এই ধর্মঘটটি ছিল একটি ঐতিহাসিক আন্দোলন, সেখানে ইউনিয়নগুলো শ্রমিকদের ওপর নিজেদের ক্ষমতা হারায়।
ব্রিটিশ শ্রম ইউনিয়নের ক্ষমতা হ্রাস
আয়রন লেডি মার্গারেট থ্যাচারের শাসনামলে বছরব্যাপী হয়েছিল খনি শ্রমিকদের আন্দোলন। সময় তখন ১৯৮৪ থেকে ১৯৮৫ সাল। তৎকালীন ব্রিটিশ ইউনিয়ন নেতা আর্থার স্কারগিল খনিগুলোর একটি তালিকা পান। যা দিয়ে তিনি থ্যাচার সরকারের পতনের পরিকল্পনা করেন। আর চাকরি হারানোর ভয়ে খনি শ্রমিকরাও ধর্মঘট করেছিল। প্রায়ই খনি শ্রমিক ও পুলিশের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। ১৯৮৫-পরবর্তী শ্রম আইন পরিবর্তিত হয়। ব্রিটিশ শিল্পের ওপর শ্রম ইউনিয়নের ক্ষমতা প্রদর্শন বন্ধ হয়ে যায়।
পিএনএস/এমএইউ
মে মাসের সেদিন কী ঘটেছিল শিকাগোতে
01-05-2024 12:40PM