এসেনসিয়াল ড্রাগস কোম্পানী লিমিটেডে টেন্ডার বাণিজ্য চলছেই : দেখার কেউ নেই?

  24-08-2019 08:07PM

পিএনএস (মোঃ শাহাবুদ্দিন শিকদার) : এসেনসিয়াল ড্রাগস কোম্পানী লিমিটেডে টেন্ডার বাণিজ্য চলছেই। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার স্বপ্নের ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার অংশ হিসেবে ই-জিপির মাধ্যমে টেন্ডার করার কথা থাকলেও বিভিন্ন কৌশলে ইডিসিএল এই প্রক্রিয়াকে বৃদ্ধাঙ্গুলী প্রদর্শন করে যাচ্ছে। সরকারের সিপিটিইউ-এর নীতিমালাকেও ইডিসিএল একেবারেই তোয়াক্কা করছে না। ইতিমধ্যে স্বাস্থ্য খাতের বেশ কয়েকটি ইউনিটে দরপত্র জালিয়াতদের শত শত কোটি টাকার দুর্নীতির প্রমাণ মিলেছে। পত্র-পত্রিকায় এ সমস্ত অভিযোগ প্রকাশের পর দুর্নীতি দমন কমিশন নড়েচড়ে বসেছে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ও বিষয়গুলো খতিয়ে দেখছে। ইডিসিএল- এর দরপত্র জালিয়াতির ব্যাপারে ইতিমধ্যেই প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, দুদক, এনএসআই, ডিজিএফআই এবং খোদ স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের নজর পড়েছে। ইতিমধ্যেই দুর্নীতির অভিযোগের ব্যাপারে নথি চালাচালিও শুরু হয়েছে। এতো কিছুর পরেও ইডিসিএল-এর দুর্নীতি থামেনি।

অভিযোগকারীদের মতে, বাংলাদেশ সরকারের স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের অধীন এসেনসিয়াল ড্রাগস কোঃ লিঃ (ইডিসিএল) একমাত্র ঔষধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান। প্রতিষ্ঠানটির প্রধান কার্যালয় ৩৯৫-৩৯৭ তেজগাঁও শিল্প এলাকায় অবস্থিত। উক্ত ইউনিট ছাড়াও বগুড়া, খুলনা, মধুপুরসহ ৫টি ইউনিট বিদ্যমান। প্রতিষ্ঠানের বর্তমান ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রফেসর ডাঃ এহসানুল কবির। তিনি দীর্ঘ ৪ বছরেরও অধিক এই দায়িত্বে আছেন। তিনি একজন সৎ ব্যক্তি হিসেবে জনশ্রুতি থাকলেও তার অধীনস্থ কিছু অসাধু কর্মকর্তা সুকৌশলে সরকারের কোটি কোটি টাকা আত্মসাত করে চলেছেন।

সূত্রমতে, ইডিসিএল- এ ব্যাপক দরপত্র জালিয়াতি চলছে। অভিযোগকারীরা জানান, ‘র’ ম্যাটেরিয়ালস ক্রয়ের ক্ষেত্রে নতুন অংশগ্রহণকারীদের স্যাম্পল জমা দিতে হয় এবং সর্বনিম্ন দরদাতা হলে তাদের প্রদেয় স্যাম্পল টেস্ট রিপোর্টের ভিত্তিতে অর্ডার দিতে হয়। এই পর্যায়ে একটি টেকনিক্যাল কমিটি রয়েছে। কারিগরী বাছাই কমিটির সদস্যরা হলেন, শওকত আলী; ব্যবস্থাপক কমার্শিয়াল, আব্দুল হালিম; ডিজিএম প্রডাকশন এবং মেশিনের জন্য প্রকৌশলী রশিদুজ্জামান। অপরজন সদ্য বিদায়ী ডি জি এম দিদারুল আলম; কিউ সি। তারা ইচ্ছা করলে তাদের মনোনীত ব্যক্তিকে অর্ডার দিতে পারেন এবং সুক্ষ্মভাবে যোগ্য ব্যক্তিকে টেকনিক্যালি বাদ দিতে পারেন। তাদের সুক্ষ্ম কারচুপির মধ্যে রয়েছে, কাঁচামাল বা ‘র’ ম্যাটেরিয়ালস আমদানির ক্ষেত্রে স্যাম্পল পাশ ফেল কাটিয়ে টিএসসি রিপোর্ট করে যাকে পছন্দ করবেন তারাই অর্ডার পাওয়ার যোগ্যতা লাভ করবেন। এখানে টিএসসি রিপোর্ট তাদের মনের মতো করে তৈরি করে আমদানীর জন্য সুপারিশ করা হয়। স্থানীয় ক্রয়ের ক্ষেত্রেও টেকনিক্যাল কমিটি স্যাম্পল গ্রহণযোগ্য নয় অজুহাতে বাদ দিয়ে পছন্দের কোম্পানীকে অর্ডার দেওয়ার সুপারিশ করেন এবং পিসি-১ তা অনুমোদন দেন। যদি কোন নতুন সরবরাহকারী টেন্ডারে অংশগ্রহণ করে সর্ব নিম্ন দরদাতা হন এবং কোন ভাবে তাকে বাদ দেয়া না যায়, তখন তাকে সামান্য কিছু অর্ডার দিয়ে বাকীগুলো নির্দিষ্ট সরবরাহকারীদের অর্ডার দেওয়া হয়। নতুন ঐ কোম্পানী মাল সরবরাহের আগে আবারো নমুনা দিতে হয় এবং ঐ সময় নমুনা বাতিল করে সুক্ষ্মভাবে প্রতারণা করে বাদ দিয়ে দেওয়া হয়। এই ভাবে শওকত ও ইদ্রিস নতুন কাউকে ব্যবসা করার সুযোগ দেন না। ক্রয়ের নথিপত্র খতিয়ে দেখলে এগুলোর প্রমাণ মিলবে।

দ্বিতীয়ত মেশিনারী আমদানীর ক্ষেত্রে এই টিএসসি কমিটি ইউআরএস স্পেশিফিকেশন অগ্রীম তৈরি করে কমার্শিয়াল বিভাগে টেন্ডারের জন্য পাঠান। সেখানে তারা যাকে পছন্দ করেন ঠিক তার নির্দিষ্ট সরবরাহকারীর স্পেসিফিকেশান দিয়ে ইউআরএস তৈরি করেন যাতে অন্যরা মিলাতে না পারেন। পরবর্তীতে এই টেকনিক্যাল কমিটি অন্যদের বাদ দিয়ে পছন্দের কোম্পানীকে অর্ডার দেওয়ার সুপারিশ করেন। পার্সেজ কমিটি-১ নামে একটি কমিটি যারা সার্ভে অব বাংলাদেশ, বিজি প্রেস এবং ড্রাগ প্রশাসন থেকে একজন প্রতিনিধিসহ এমডি সাহেব ক্রয়ের অনুমোদন দেন।এখানে পিসি-১ মোটেই বুঝতে পারেন না ‘টিএসসি’ কি ধরণের জালিয়াতি করেছে। এর উদাহরণ হিসেবে গত ৩ বছরে যত মেশিন ক্রয় করা হয়েছে তার পুরো হিসাব নিয়ে জানা যায়, শুধুমাত্র একজন সরবরাহকারী শতকরা ৮০ ভাগ মেশিন সরবরাহ করেছেন এবং এই কোম্পানি হতে উক্ত কমিটি আর্থিক ভাবে লাভবান হয়েছে বলেও জানা যায়। এই কোম্পানি বাংলাদেশের কোন ঔষধ কোম্পানীতে একটি মেশিন বা পার্টস সরবরাহ করেনি, কোন পূর্ব অভিজ্ঞতা নেই বরং তাদের কোন নিজস্ব টেকনিক্যাল লোক নেই যা দরপত্রের একটি শর্ত বটে এবং যাচাই বাছাই না করে একচেটিয়া অধিক মূল্যে নিম্ন দর দাতাদের পাশ কাটিয়ে তাকে উচ্চমূল্যে অর্ডার দেওয়া হচ্ছে।

খোজ নিয়ে জানা যায়, কমার্শিয়াল ডিপার্টমেন্টের একজন জেনারেল ম্যানেজার থাকলেও শওকত আলী, ম্যানেজার কমার্শিয়াল সকল ক্ষমতার অধিকারী, যিনি এমডি সাহেবের একজন প্রিয়ভাজন। তিনি যাকে ইচ্ছে করেন, তাকে অর্ডার দিবেন এবং ঐভাবে টিএসসি কমিটিকে ব্যবহার করে থাকেন। কমার্শিয়াল ডিপার্টমেন্টের সকল দরপত্রের ফাইল (স্থানীয়াভাবে এবং আন্তর্জাতিক ভাবে) দেখলে পুরো অনিয়ম পরিস্কার হয়ে যাবে। তার অন্যতম সহযোগী ইদ্রিস আলী; সিনিয়র কমার্শিয়াল অফিসার। তার আবার নিজস্ব সখ্যতা রয়েছে একটি প্রতিষ্ঠানের সাথে। এই কোম্পানীর বয়স ৪ বৎসর হলেও ইদ্রিস আলী আর্থিক লাভবান হওয়ার স্বার্থে তাকে প্রচুর অর্ডার দিচ্ছেন যা পুরানো সকল ব্যবসায়ীদের রেকর্ড ছাড়িয়েছে। এই কোম্পানী আর কোন ঔষধ কোম্পানীর সাথে ব্যবসা না পেলেও ইডিসিএল এ এখন বড় ‘র’ ম্যাটেরিয়ালস সরবরাহকারী। যে কোন স্যাম্পল টেন্ডারের সাথে জমা দেওয়ার নিয়ম থাকলেও ঐ প্রতিষ্ঠানটি গোপনে মিঃ ইদ্রিস ও শওকত আলীর সহযোগিতায় আগাম স্যাম্পল পাশ করিয়ে রাখেন এবং কাকতালীয় ভাবে তারা টেন্ডারের পর দরপত্র পরিবর্তন করে চিহ্নিত প্রতিষ্ঠানকে সর্বনিম্ন দরদাতা হিসেবে অর্ডার দিয়ে থাকেন। গত ৩ বৎসরে অর্ডারের হিসাব মিলালে প্রকৃত সত্য বের হয়ে আসবে বলে সকলের বিশ্বাস।

ম্যানেজার কমার্শিয়াল শওকত আলী; স্থানীয়ভাবে ক্রয়ে তার মনোনীত বা পছন্দের ব্যবসায়ীকে ব্যবসা দেন। তিনি টেকনিক্যালি অন্যদের বাদ দিয়ে তার নিজের সুবিধা লাভের জন্য সরবরাহকারীদের নিয়মিত অর্ডার দিয়ে থাকেন। উল্লিখিত এই কয়েকজন একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট এবং তারা প্রভাব বিস্তার করে সরকারের আর্থিক অপচয় করে নিজেরা লাভবান হচ্ছেন। এই সিন্ডিকেট অচিরেই ভেঙ্গে তাদের অন্যত্র বদলী করে দিলেই তাদের হাত থেকে সরকারের কোটি কোটি টাকা আত্নসাত এবং কারখানা পরিদর্শনের নামে বিদেশ ভ্রমণ বন্ধ হয়ে যাবে বলে সকলের ধারণা।

অভিজ্ঞমহলের মতে, বর্তমান স্বাস্থ্যমন্ত্রী একজন সজ্জন মানুষ। তিনি চান না তার অধীনস্থ দপ্তরগুলোতে কোন দুর্নীতি-অনিয়ম হোক। ইতিমধ্যে তিনি সংশ্লিষ্ট সকলকে কড়া নির্দেশনাও দিয়েছেন। কিন্তু ইডিসিএল- এর দুর্নীতিবাজ চক্র এখনো দুর্নীতি থেকে সরে আসেনি বরং তাদের দুর্নীতির মাত্রা দিনে দিনে বৃদ্ধি পাচ্ছে।

ভূক্তভোগীমহল মনে করেন, ইডিসিএল- এর দুর্নীতিবাজ সিন্ডিকেটকে থামাতে না পারলে সরকারের বিপুল পরিমান অর্থ অপচয়ের পাশাপাশি স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় ইমেজ সংকটে পড়তে পারে। এ ব্যাপারে জরুরী ভিত্তিতে একটি শক্তিশালী তদন্ত কমিটি গঠনের পাশাপাশি দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা গ্রহণের জোর দাবী জানানো হয়েছে। (চলবে)।

@PNSNews24.com

আপনার মন্তব্য প্রকাশ করুন